স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি


১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র। সেদিন এ কেন্দ্র থেকেই সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম হান্নান আনুমানিক বেলা দুইটায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করেন। এ ঘোষণা ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলে।

এবার দেশ স্বাধীনের জন্য সবাইকে একতাবদ্ধ করতে হবে। সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ জন্য দরকার প্রচারমাধ্যম। বেলাল মোহাম্মদসহ কয়েকজন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তখন সৈয়দ আবদুল কাহ্হার ছিলেন চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রের একজন পরিচালক। বেলাল মোহাম্মদ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। আবদুল কাহ্হারের কথা হলো, কোনোভাবেই যেন আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার করা না হয়। কারণ, যেকোনো সময় পাকিস্তানি সেনারা এর দখল নিতে পারে। কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে ব্রডকাস্টিং নিরাপদ হবে। বেলাল মোহাম্মদের দল কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন।
আওয়ামী লীগের কর্মী আনোয়ার আলীর গাড়িতে সবাই কালুরঘাটে রওনা হলেন। আনোয়ার আলী বেলাল মোহাম্মদের কাছে একটি সাইক্লোস্টাইল প্রচারপত্র দেন। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। তখন গাড়িতে ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ, চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ আল-ফারুক ও ঘোষক হোসনে আরা।
কালুরঘাট যাওয়ার পথে গাড়িতে আরও উঠেছিলেন কবি আবদুস সালাম। ফজল হোসেন ও সুলতানুল আলম নামের আরও দুজন ঘোষক। সবাই বেতার কেন্দ্রে এলেন। কোনো প্রস্তুতির সুযোগ ছিল না। আবুল কাসেম সন্দ্বীপ দ্রুত একটা বুলেটিন তৈরি করলেন। ফজল হোসেনের কণ্ঠ চট্টগ্রামে খুব পরিচিত। তিনি ঘোষণা করলে তাঁর পরিবারের জন্য বিপদ হতে পারে। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’
৩০ মিনিটের মতো এ অনুষ্ঠান চলেছিল। এ অধিবেশনেও এম এ হান্নান আবার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচার করেন। ডাক্তার আনোয়ার আলীর কাছ থেকে পাওয়া ঘোষণাপত্রটি আরও কয়েকজন প্রচার করেছিলেন। কবি আবদুস সালাম পড়েছিলেন—কারও নির্দেশে নয়, কারও প্ররোচনায় নয়, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমরা শুরু করলাম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।
রাত সাড়ে ১০টায় বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীরা মুশতারী লজে ফিরে এলেন। গভীর রাত পর্যন্ত পরের দিনের প্রস্তুতি চলল। প্রস্তুতির মধ্যে ছিল বিদেশি বেতার শুনে খবর নোট করা। সে কাজে সাহায্য করেছিলেন বেগম মুশতারী শফীর ছোট ভাই খন্দকার এহসানুল হক আনসারী। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সেনারা ডাক্তার শফী ও বেগম মুশতারীর ছোট ভাই আনছারিকে ধরে নিয়ে যান। তাঁরা আর কোনো দিন ফিরে আসেননি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তাঁরা শহীদ হন।
২৬ মার্চ রাত দুইটায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সে সময়ের সভাপতি জনাব এম আবদুল হান্নান শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর জন্য পাঁচ মিনিটের একটি ভাষণ দেন।
২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে আবার কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে অধিবেশন শুরু। কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে অধিবেশন শুরু হয়। তিলাওয়াত করেন চট্টগ্রামের গীতিকার আবদুল সালাম। সে সময়ে চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। তিনি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি ২৭ তারিখের সন্ধ্যা অধিবেশনে আবার পড়েন।
এর কিছুক্ষণ পর কবি আবদুস সালাম একটি ভাষণ দেন, ‘প্রিয় বাংলার বিপ্লবী সন্তানেরা। স্বাধীনতাহীন জীবনকে ইসলাম ধিক্কার দিয়েছে। আমরা আজ শোষক প্রভুত্ব লোভীদের সঙ্গে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি। এই যুদ্ধে যারা জীবন দেবে, কোরআন করিমের ভাষায় তারা মৃত না, অমর। দেশবাসী ভাইবোনেরা আজ আমরা বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম করছি। জয় বাংলা।’
২৭ থেকে ২৯ মার্চের মধ্যে এই দলের সঙ্গে যুক্ত হন সৈয়দ আবদুল শাকের। রাশিদুল হোসেন। আমিনুর রহমান। শারফুজ্জামান। মুস্তফা আনোয়ার। রেজাউল করীম চৌধুরী ও কাজী হাবিব উদ্দীন। এই ১০ জনই হলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা।
বিভিন্ন সময় এই দলের সঙ্গে অনেকে যুক্ত হয়েছে। নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। ওই অবরুদ্ধ দিনগুলোতে যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের কারও অবদান কম না। একসঙ্গে ১০ জন হওয়ায় তাঁদের কাজের শক্তি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এখানে পদ–পদবির কোনো বালাই ছিল না। এগুলো সবাই আগ্রাবাদেই ফেলে এসেছিলেন।
২৬ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট থেকে প্রথম অনুষ্ঠান সম্প্রচারের প্রথম বাক্যটি ছিল, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’

সাংবাদিক ও সংগঠক