আবার দেখা হবে

পুসান আর আবুধাবি নিয়ে লিখতে বসেই একটা দারুণ খবর পেলাম। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র পত্র ভ্যারাইটি থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার-এর ওপর একটি রিভিউ ছেপেছে। রিভিউতে তারা ছবিটার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লিখেছে ‘নান্দনিক ছবির সংবেদনশীলতা আর উপমহাদেশীয় উপকরণের সমন্বয়ে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার একটি আপাদমস্তক আধুনিক এবং নব আঙ্গিকের ছবি।’ লেখায় এর অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার পরিমিত এবং যথাযথ অভিনয়ের দিলখোলা প্রশংসা করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, ছবিটাকে ফেস্টিভ্যাল সার্কিটে তৃতীয় বিশ্বের ছবির তকমা লাগিয়ে ঢুকতে হবে না, ছবির নিজ গুণেই এটি ফেস্টিভ্যাল সার্কিটে হাজির থাকবে। আমার বিশ্বাস, এটি আমার একার সাফল্য নয়। দশ বছর ধরে যে সব দর্শক আমাদের ভিডিও ইন্ডাস্ট্রিতে পরিবর্তনের পালে হাওয়া লাগিয়ে চলেছেন, তাঁরা সবাই এর অংশীদার। জয়তু বাংলাদেশ। জয়তু বাংলাদেশের নতুন দর্শক। এবার যাই উত্সব প্রসঙ্গে। প্রথম যখন জানতে পারলাম, পুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব কর্তৃপক্ষ তাদের ২০০৯-এর উত্সবের জন্য থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবিটা নির্বাচন করেছে, তখন আমার অনুভূতিটা ছিল ‘অবশেষে আমি ইহারে পাইলাম’। এর আগে ব্যাচেলর আর মেড ইন বাংলাদেশ বানালেও সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমার তেমন কোনো অবস্থান ছিল না। সেখানে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার প্রিমিয়ার হবে পুসানের মতো কুলীন চলচ্চিত্র উত্সবে, যেটা এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বের সেরা দশটার একটা হিসেবে বিবেচিত। স্বাভাবিক কারণেই আমি ভীষণ খুশি ছিলাম। কিন্তু খটকা লাগল যখন আমার আশপাশের লোকজনকে সুখবর জানাতে গেলাম। ‘পুসান’? ‘এটা কী’? ‘আহ্ বস, লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভালে কেন দিলেন না’? যেন শহরটা বিখ্যাত হলে ফেস্টিভালটাও বিখ্যাত হবে। যা-ই হোক, পুসান সম্পর্কে মোটামুটি ছোটখাটো একটা ধারণা দিয়ে রওনা হলাম পুসানের উদ্দেশে। গিয়ে আসলে যা দেখলাম, তা আমি যতটুকু জানতাম তার চেয়েও বেশি। পুরো শহরে যেন উত্সব চলছে। ২০টির মতো হলে ছবির প্রদর্শনী। আরেক জায়গায় এশিয়ান ফিল্ম মার্কেট। আরেক জায়গায় এশিয়ান ফিল্ম পলিসি ফোরাম, আরেক জায়গায় এশিয়ান ফিল্ম একাডেমি পরিচালিত তরুণ পরিচালকদের কর্মশালা। দুই লাখের অধিক দর্শক, তিন হাজার পরিবেশক এবং ক্রেতা, অন্য ফেস্টিভালের পরিচালক, প্রোগ্রামার, সমালোচকসহ ১০ হাজারের অধিক বিদেশি অতিথি—সব মিলিয়ে এক এলাহি কারবার। অক্টোবরের ১০ ও ১৩ তারিখ—এই দুই দিন ছিল আমার প্রদর্শনী। মাঝখানে বেশ কিছু পার্টি আর ১২ তারিখের কোরিয়ার সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র-সাময়িকী সিনে ২১-এ আমার সাক্ষাত্কার। মোটামুটি চোখের পলকে ১৩ তারিখ চলে এল। ১৩ তারিখে শো শেষে ছিল দর্শক-সমালোচকদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব। প্রদর্শনীতে বার্লিন ও সানড্যান্স-এর প্রোগ্রামার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক, সমালোচক এবং বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের একটা দল। ছবিটা যে তারা দারুণভাবে গ্রহণ করল, এটা বোঝা গেল ৪৫ মিনিটেরও বেশি আকর্ষণীয় প্রশ্নোত্তর পর্বে। নানা রকম প্রশংসার চেয়েও আমি বেশি আনন্দ পেলাম, ছবিটাকে যে তারা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তা দেখে। আমার সফরসঙ্গী রুমি ভাইয়ের দায়িত্ব ছিল এগুলো ভিডিও করার। তিনি করেছেনও। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার ক্যামেরা খুঁজে ফিরেছে সুন্দরী নারীদের মুখ! আশা ছিল, এগুলো দিয়ে ডকুমেন্টারি বানানো হবে। এখন সেটা করতে গেলে যে কী দাঁড়াবে, আল্লাহই জানে!তো যা-ই হোক, প্রশংসায় মোটামুটি ডগমগ হয়ে পুসান থেকে উড়ে গেলাম আবুধাবি। ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে যেথা’। প্রাণের মানুষটা কে? কে আবার আব্বাস কিয়ারোস্তামি ছাড়া? ইরানের খ্যাতনামা পরিচালক। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে সম্মানিত চলচ্চিত্রকারদের একজন। তিনি আছেন আবুধাবির মিডল ইস্ট ফিল্ম ফেস্টিভালের জুরি-প্রধান হয়ে। সম্মানজনক ওই প্রতিযোগিতার ১৮টি ছবির মাঝে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারও একটি। পুরস্কার পাব না, জানি। কারণ এই ১৮টির মাঝে কান থেকে তিনটি, ভেনিস থেকে তিনটি, টরন্টো থেকে চারটি, সান সেবাস্টিয়ান আর পুসান থেকে একটি করে। এর মাঝে কানে অ্যাওয়ার্ড পাওয়া ছবিও আছে। কিন্তু আমার উত্তেজনা অন্য জায়গায়। আব্বাস কিয়ারোস্তামি দেখবেন আমার ছবি। যাঁর ছবি দেখে আমরা নিজেদের তৈরি করেছি, তিনিই আজ আমার ছবি দেখবেন, হয়তো তাঁর সঙ্গে দেখাও হবে। এই উত্তেজনা কেমনে সামলাই?উত্তেজিত অবস্থায় সিউল এয়ারপোর্টে পৌঁছেই ধাক্কা খাই। এমিরেটস আমাকে বহন করতে নারাজ। কারণ আবুধাবি থেকে আমার যে ভিসা পাঠানো হয়েছে, সেখানে আমার জন্মতারিখ লেখা ১০/০৫/১৯৫৫ । অর্থাত্ আমার বয়স তাদের হিসাবমতে ৫৪ বছর। খুব মনে পড়ল কচি খন্দকারের কথা। যার বয়স সারা জীবন আমরা ১০ থেকে ২০ বছর বাড়িয়ে বলতাম। আজ সেই এই কূপে আমিও পতিত! যা-ই হোক, আমার সফরসঙ্গী বিখ্যাত চাপাশিল্পী রুমী ভাই এবং আবুধাবি সরকারের ত্বরিত্ হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত আবুধাবির বিমানে চাপতে পারলাম। ‘আব্বাস আমি আসিতেছি’। আবুধাবি পৌঁছেই উত্সবে নানা চক্করে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও আমার চোখ কিন্তু খুঁজে ফিরছে ‘প্রাণের মানুষ’কে। ‘প্রাণের মানুষ তুমি কোথায়’? একদিন দুপুরে লাঞ্চ করছি আমি, সাগর ভাই, কনা আপা/ভাবী, রুমি এবং তিশা। হঠাত্ ঢুকলেন তিনি। আমি গলা নামিয়ে বললাম ‘ওই যে কিয়ারোস্তামি! আমি তাহারে পাইলাম’। সাগর ভাই চাপাচাপি করলেন ‘যাও, পরিচিত হও’। জগতের সব মধ্যবিত্ত-আড়ষ্টতা আমাকে অবশ করে দিল, যাওয়া হলো না। পুরস্কার প্রদানের দিন। ইঙ্গিত পেলাম, আমি অথবা আমাদের ছবির কেউ একজন পুরস্কার পাবে। পুরস্কার ঘোষণা শেষ। আমাদের নাম কোথাও নেই। এক লাখ ডলার উত্তাপ ছড়িয়ে আমারও আঙিনা দিয়ে আনবাড়ি চলে গেল। অডিটোরিয়াম থেকে বের হওয়ার আগে অনেক বিদেশি সাংবাদিক সহানুভূতি জানাল, জানাল যে তারা আশা করেছিল, আমরা পাব। এর মাঝে একটা ফরাসি সাংবাদিকদের দল তিশাকে ঘিরে ধরল। তারা একই কথা জানাল ‘আমরা বিশ্বাস করি, তোমারই পুরস্কারটা পাওয়া উচিত ছিল।’ যা-ই হোক, কোনো কথাতেই চিঁড়ে ভিজছে না। মন শান্ত হচ্ছে না। সাগর ভাই নানা রকম মনভোলানো কথায় সান্ত্বনা দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু চিঁড়া ভিজছে না। হঠাত্ ওই উত্সবের দুই প্রোগ্রামার স্টেলা আর জেনিবা বলল, আমরা যদি চাই কিয়ারোস্তামির সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে পারি। মনে মনে বললাম, ‘আমাকে পুরস্কার দেয় নাই, আবার তার সঙ্গে সাক্ষাত্!’ খুব বেশি আগ্রহ পেলাম না। তিশার উত্সাহেই রওনা দিলাম ভিআইপি জোনে থাকা আব্বাস কিয়ারোস্তামির পথে। আমরা ভাবি এক, আর ঈশ্বরের পরিকল্পনা থাকে আরেক। আমি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনি আমাদের জন্য ওখানে কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে। পরিচয়পর্ব শেষ হতেই কিয়ারোস্তামি যে ভাষায় আমার ছবির এবং তিশার প্রশংসা করতে থাকল, তাতে আমি আবার অবশ হয়ে গেলাম। প্রায় ১০ মিনিটের মতো ছিলাম। বেশির ভাগ সময় উনি বলে গেলেন। যদিও আমার অনেক কিছুই বলার ছিল, আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার ছবির প্রশংসার এক পর্যায়ে কিয়ারোস্তামি ‘এই নাও তোমার পুরস্কার’ বলে একটা মোটামুটি দীর্ঘস্থায়ী চুমু বসিয়ে দিলেন গালে। এরপর তিশার দিকে ঘুরে তিশার প্রশংসা করে বললেন ‘ধরে নাও তুমি পুরস্কার পেয়েছ।’ ঠিক ওই মুহূর্তে আমি চরম আশঙ্কায় আছি, এখনই বুঝি কিয়ারোস্তামি সাহেব আমাকে যে পুরস্কার দিয়েছেন তিশাকেও সেটি বরাদ্দ করে বসেন! তবে এইবার আমার চিড়ে ভিজল। ফুরফুরে মন নিয়ে সিনা টানটান করে পার্টিতে ঘুরে বেড়ালাম। পরদিন উনি ইরান যাওয়ার আগে কার-পার্কে আবার সাক্ষাত্। এইবার ছবিটা নিয়ে আরও বিস্তারিত কথা বললেন। বাংলাদেশের ছবি যে এত দূর এগিয়েছে, এটাতে বিস্ময় এবং আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমি এবার কথা বলতে পারলাম। বললাম, আমাদের দেশে ভিডিও মাধ্যমে রীতিমতো আন্তর্জাতিক মানের কাজ হচ্ছে। এই সব তরুণ পরিচালকের খোঁজ সারা পৃথিবী এখনো না জানলেও আগামী পাঁচ-দশ বছরের মাঝেই জানবে। আরও বললাম, নিজের সহকারী পরিচালকদের পরিপূর্ণ পরিচালক হতে অনুপ্রাণিত করার দীক্ষাটাও বহুদূর থেকে বসে আমি তাঁর কাছ থেকেই নিয়েছি। তিনি আমাদের সবার জন্য শুভেচ্ছা দিয়ে এই ছবি নিয়ে আমার ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা এবং আগামী ছবির পরিকল্পনা জানতে চাইলেন। আমি সব বললাম। ‘আবার দেখা হবে’ বলে লিমুজিনে চেপে চলে গেলেন। আমি আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানালাম, যা কিছু ঘটল তার সবকিছুর জন্য। ছবিটা আগামী মাসে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ায় মুক্তি পাবে। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আমাদের লক্ষ-কোটি ভাই-বেরাদর এবং বোন-সিস্টারদের প্রতি তিনটা কথা আছে বলবার। এক. আপনারা যে শহরেই থাকুন, আপনাদের নিকটবর্তী সবচেয়ে ভালো হলটার মালিককে উদ্বুদ্ধ করুন ছবিটা আনার জন্য। তারপর দলে দলে হলে গিয়ে ছবি দেখুন। কেবল আপনারাই পারেন বদলাতে। দুই. পাইরেসিকে না বলুন। কোনো হলে কেউ যেন মোবাইল ক্যামেরার সাহায্যে ছবি রেকর্ড না করে, সে দিকে খেয়াল রাখুন। লক্ষ রাখুন, কেউ যেন এটির পাইরেটেড ডিভিডি বের করার চেষ্টা না করে। কেবল আপনারাই পারেন এ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে। তিন. এত সব উত্সবের গল্প শুনে ভাববেন না যে এই ছবি বোধহয় ‘আমাদের’ জন্য নয়। ভাইয়েরা আমার (এবং বোনেরাও নিশ্চয় আমার), ভয়ের কারণ নাই, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার কোনো ‘আর্ট ফিল্ম’ নয়, এটা হচ্ছে ‘হার্ট ফিল্ম’।