পল্টু বাবাই

০১.
-কী করছ, পিকুল? এখনো হয়নি তোমার? সেই কখন থেকে বলছি রেডি হও রেডি হও। আমার কথা তো তোমার কানেই যায় না।
-সরি, নীরু। এই তো হয়ে গেছে প্রায়।
-তোমার হয়ে গেলে বাবাইকে কোলে নাও। শুনতে পাচ্ছ না কেমন কাঁদছে ছেলেটা? আচ্ছা, দেখো তো ও হিসু করেছে কি না?
- না। ও ঠিক আছে। দ্রুত সারো তো। ডাক্তার ইসরাতের সঙ্গে দেখা করে আমরা বাবাইর জন্য কেনাকাটা করতে মার্কেটে যাব।

০২.
ঠিকই ধরেছেন, যার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলাম, সে নীরা—আমার স্ত্রী। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজুগুজু করছে। আর বাবাই? আমাদের একমাত্র সন্তান। ওর বয়স চার মাস। নীরা পছন্দ করে ছেলের নাম রেখেছে পল্টু বাবাই। সারা দিন পল্টুকে নিয়েই সে থাকে। বেশ চটপটে ও প্রাণবন্ত মানুষ নীরু। ঘরে তার উপস্থিতি মানেই বিষণ্ন রাতে একগাল জোছনার মতো। তার হাসি মানেই গহিন জলের ছলাৎ সুর। খুব মিশুক ও কেয়ারিং নীরু। ও, হ্যাঁ, আমাদের কিন্তু অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। ছয় বছর হলো মায়ের পছন্দেই নীরাকে বিয়ে করেছি।
পল্টুর বড় বোন পরী। ও অবশ্য পৃথিবীর আলোই দেখেনি। সাত মাস বয়সে নীরুর পেটেই সে মারা যায়। পরীর চলে যাওয়ার পর নীরু আর তেমন কারও সাথে কথা বলত না। বিনা নোটিশে আমার সাথে খুব অভিমান করত। হুটহাট আবদার করে বসত।একদিন হলো কী, ভরা পূর্ণিমা রাতে সে আবদার করে বসল, বটগাছের নিচে বসে জোছনা দেখবে। তার কথামতো শহরতলি থেকে প্রায় দুই মাইল পথ পায়ে হেঁটে খেয়াঘাটের বটতলায় বসে মধ্যরাত পর্যন্ত আমরা জোছনা দেখেছি। মাঝে মাঝে রাতে ঘুমের মধ্যে নীরু হঠাৎ কেঁদে উঠত। নীরুর জন্য খুব কষ্ট হতো আমার। ওই দিনগুলোতে নিজেকে খুব অসহায় লাগত।
পল্টু বাবাই পেটে আসার পরই নীরু পুরোদস্তুর স্বাভাবিক হয়ে যায়। নীল শাড়ি পরে। বারান্দায় বসে প্রায়ই রবীন্দ্রসংগীত গায়। পল্টুকে নিয়ে হাজারো স্বপ্নের নকশিকাঁথা বুনন করে। আমিও গদগদ হয়ে তার সব প্ল্যানে হুম হুম করি। গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হাসি আহমেদের তত্ত্বাবধানে আছে নীরু। ডাক্তারের পথ্য ও নির্দেশনা খুব মনোযোগ দিয়ে পালন করে সে। বমির ভাব হলেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে রুটিনমাফিক পুষ্টিকর খাবার পানি দিয়ে গিলে খায়। কার কাছে যেন শুনেছে, ভালো খাবার আর মায়ের হাসিখুশি থাকার ওপর নির্ভর করে পেটের শিশুর বিকাশ। তাই সে সব সময় হল্লা করে ঘরটাকে মাথায় তুলে রাখে। আমার কাছেও ঘরটা স্বর্গের মতোই ঠেকে।
সারা দেশ লকডাউন। করোনা নামের এক অদৃশ্য যমদূত পুরো বিশ্বকে শাসন করছে। প্রতিদিনই হাজারো লাশের সারি পড়ছে। একদিন ভোরে নীরুর ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। পেটটা দুহাতে চেপে ধরে বলল, পেটব্যথা খুব হচ্ছে। বুঝতে বাকি রইল না যে নীরুর প্রসববেদনা উঠেছে। নীরুর মা ও তার বড় বোন খবর পেয়েই সাথে সাথে চলে এসেছে। সবকিছু স্বাভাবিক। নীরুও বেশ সুস্থ। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী আঁতুড়ঘরে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন। এদিকে আমি পল্টুর কান্নার আওয়াজ শোনার জন্য আঁতুড়ঘরের দরজায় কান পেতে রইলাম। ছোট ভাই আতিক আজান দেওয়ার জন্য অজু করে এসেছে। ডাক্তার নীরুর শরীরে স্যালাইন ও ইনজেকশন পুশ করার কিছুক্ষণ পরই পল্টু পৃথিবীর আলোয় এল। কিন্তু কোনো কান্না করছে না। নীরুর মা দরজা খুলেই কান্না শুরু করল। পল্টু বাবাই শ্বাস নিতে পারছে না। আগে থেকেই অ্যাম্বুলেন্স বলা ছিল। অ্যাম্বুলেন্সে করে আমরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছি। প্রাইভেট হাসপাতালের দরজায়ও লেখা Closed. আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও পল্টুকে সুস্থ করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাচ্ছিলাম। পরীর মৃত্যুর পর নীরুর যে মুখটা দেখেছিলাম, সেই মুখটাই বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এবার পল্টুর কিছু হলে নীরুকে বুঝি আর বাঁচানো যাবে না।
অবশেষে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে একজন ডাক্তারকে পেলাম। তিনি সবকিছু দেখে সরি বলে চলে গেলেন। বিশ্বাস করুন, আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও গড়ায়নি। বাড়ি ফেরার পুরোটা পথ আমি পল্টু বাবাইকে দেখছিলাম। মন ভরে দেখছিলাম। আসলে আমি পল্টুকে দেখছিলাম না, দেখছিলাম নীরুকে। নীরুর পুরো সত্ত্বা পল্টুর গালে খেলা করছিল!
আমাদের বকুলতলায় পল্টুর কবর খোঁড়া হয়েছে। সাদা কাফনে মোড়ানো পল্টু বাবাই আমার কোলে ঘুমাচ্ছে। নীরুর সামনে কান্না লুকাতে গিয়ে আমার মাথার পেছনটা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন। নীরুকে বাঁ হাতে আমার বুকে চেপে ধরেছিলাম। ডান হাতে ধরে রেখেছি আমাদের পল্টুকে। পল্টু ঘুমাচ্ছে। পল্টুর লকলকে আঙুল ধরে নীরু ডাকছে, ‘বাবাই রে, এবার আমার কোলে আয়। এই দুষ্টু, তোকে আর ঘুমাতে হবে না। জানিস, তোর জন্য আমি অনেকগুলো বল কিনেছি, গাড়ি কিনেছি। আয়, আমরা খেলব। কত রাত না ঘুমিয়ে আমি তোকে শোনাব বলে অনেকগুলো কিচ্ছা শিখেছি। বেশ কটা রাইমস শিখেছি। বাবাকে এবার ছাড়। আমার কোলে আয় সোনা।’

০৩.
এরপর নীরুর জ্ঞান ফিরে আসে দুদিন পর। চার মাস ধরে সে খুব মানসিকভাবে অসুস্থ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ইসরাত জাহানের পরামর্শে তাকে পল্টুর মতো একটা পুতুল কিনে দিয়েছি। নীরু সন্তান প্রসব করলেও সে মা হতে পারেনি। বিশ্বাস করুন, নীরু নিঃসন্তান নয়। সে বন্ধ্যা নয়। এই যে আপনারা যেই পুতুলটা দেখছেন, আসলে সেটা পুতুল নয়। ও আমাদের পুতুল পুতুল পল্টু বাবাই।

পলাশ, নরসিংদী।