পুতুল

অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি। হাঁটা পথ। মিনিট পনেরো সময় লাগে। তাই রোজ হেঁটেই বাড়ি ফিরি। অফিস থেকে বের হয়ে কানে হেডফোন গুঁজে হাঁটা দিলাম। হঠাৎ মাঝবয়সী এক লোক সামনে এসে পড়ল। কী যেন বলছে বিড়বিড় করে। গান শোনাতে মনোযোগ ছিল, হঠাৎ এমন পরিস্থিতিতে হকচকিয়ে তাকালাম। হেডফোন খুলে ফেললাম, কী বলছে লোকটা?
-একটা পুতুল কিনে দেবে, মা?
-মানে! কে আপনি? কী বলছেন?
-একটা পুতুল কিনে দেবে, মা?
-আপনি কে কোথায় থাকেন?
সেই একই উত্তর এল,
-একটা পুতুল কিনে দেবে, মা?
মেজাজটা সপ্তমে উঠল। কটমট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-ইয়ার্কি মারছেন? কে আপনি, কোথায় থাকেন, কী করেন, কিছুই বলছেন না। শুধু এক কথা বলে চলেছেন পুতুল কিনে দেবে, পুতুল কিনে দেবে। আপনি কি বাচ্চা ছেলে যে পুতুল কেনার জন্য বায়না করছেন। মানুষকে টাকা চাইতে দেখেছি, খাবার চাইতে দেখেছি, কাপড় চাইতে দেখেছি, আপনার মত পুতুল চাওয়া ভিক্ষুক এই প্রথম দেখলাম। আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো?
রাগে গজ গজ করতে করতে একটানা কথাগুলো বলে থামলাম। দেখি, লোকটা সেই একই কথা বলে চলেছে—একটা পুতুল কিনে দেবে মা?
নাহ, এবার কেমন সন্দেহ হলো। এতগুলো কড়া কথা শোনালাম, কোনো হেলদোল নেই। লোকটা পাগল নয় তো!
বাসায় ফেরার তাড়া ছিল। খুব কাছের দুই বন্ধু পূষণ আর রিমি এসেছে কানাডা থেকে। সন্ধ্যায় বাসায় ইনভাইট করেছি। একেবারে ডিনার করিয়ে তারপর বিদায় দেব। মা-বাবা কেউ বাসায় নেই। ছোট মামি অসুস্থ। তাকে দেখতে গিয়েছে সকালে। মামি নাকি মাকে থেকে যেতে জোর করছে। বাবাও মাকে একা রেখে আর এল না। কাল মাকে নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফিরবে। ফোন করেছিল যেন সাবধানে থাকি। বাসায় গিয়ে সব অ্যারেঞ্জমেন্ট আমাকেই করতে হবে। পূষণ আর রিমি দুজনই রিলেশন করে বিয়ে করে সেটেল হয়েছে। কত দিন পরে প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, ভাবতেই অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছিল। তার মধ্যে এই উটকো লোকের ঝামেলা। আগে একে কখনো দেখিনি। আর কথা বাড়ালাম না। কোন ঝামেলা হলে ফেঁসে গেলে ওরা এসে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। কেমন হবে ব্যাপারটা। তাড়াতাড়ি লোকটাকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
বহুদিন পরে তিন বন্ধু মিলে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। কত পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা। আমাদের তিন বন্ধুকে নিয়ে ক্যাম্পাসে সবাই জেলাস হতো। ক্যাম্পাসের পাট চুকিয়ে পুষণ আর রিমি সেটেল হলো। পুষণ স্কলারশিপ নিয়ে কানাডায় গিয়ে আর ফিরল না। রিমিকেও নিয়ে গেল পরে। প্রায় বছর তিনেক পর দেখা হলো আমাদের।
ওদের বিদায় দিয়ে সব গুছিয়ে রেখে ঘুমাতে গেলাম। বেড কর্নারের ওপর গিফট পেপার দিয়ে মোড়ানো প্যাকেটটার দিকে চোখ পড়ল। ওটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসলাম। পুষণ আর রিমি এনেছে আমার জন্য। খুব আগ্রহ নিয়ে প্যাকেট খুলতেই আমার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। আরে এ তো সেই পুতুলটা, যেটা চুরির অপবাদে বাড়ির কাজের মেয়েটাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর এই তো পুতুলের হাতে সেই সোনার ব্রেসলেট পরানো।
আসলে বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। বাবা নেপাল থেকে একটা পুতুল এনে দিয়েছিল আমাকে। পুতুলটার বিশেষত্ব হলো এটা কথা বলতে পারত। পুতুলটাকে নিয়েই ঘুমাতাম ,তখন অনার্স থার্ড ইয়ার। একদিন ক্যাম্পাস থেকে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। বাসায় ফিরে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমার হাতের সোনার ব্রেসলেটটা খুলে পুতুলের হাতে পড়িয়েছিলাম। তারপর আর খোলা হয়নি, রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরদিন সকালে ক্লাস টেস্ট ছিল, তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাসে চলে গিয়েছিলাম। ব্রেসলেটটার কথা মনে ছিল না। তার দুদিন পর হঠাৎ খেয়াল করে দেখি পুতুলটাও নেই আর সেই ব্রেসলেটটাও নেই।
১৩ বছরের এক মেয়ে কাজ করত আমাদের বাসায়। গ্রাম থেকে এনেছিল বাবা। মেয়েটার বাবা নাকি খুব গরিব। মাকে রান্নার কাজে, ঘরের কাজে হাতে হাতে সাহায্য করত। এই পুতুলটা আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি কাউকে ধরতে দিতাম না। একদিন দেখেছিলাম ওই মেয়েটা পুতুলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঘর গোছাতে এসে। খুব বকে ছিলাম সেদিন ওকে। পুতুল যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন কোনো কিছু না ভেবে এক বাক্যে আমি মেয়েটাকেই দোষ দিলাম। একে আমার পুতুল, তাতে পুতুলে পরানো ছিল আমার সোনার ব্রেসলেট। বারবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও মেয়েটির চুরি করেনি বলে হাতজোড় করে কান্নাকাটি করেছিল। কিন্তু মা আর তাকে বাড়িতে রাখেনি। গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিল পরের দিনই।
কিন্তু কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছি না এই পুতুল পুষণ আর রিমি কোথায় পেল। পুতুলটা হাতে তুলে নিতেই নিচে একটা সাদা কাগজ ভাঁজ করা।
খুলে দেখলাম রিমি লিখেছে—
প্যাকেট খুলে তুই অবাক হয়েছিস জানি। কিন্তু আমি পাঁচ বছর ধরে নিজের বিবেকের যন্ত্রণায় জ্বলেপুড়ে মরছি। আর পারলাম না রে। পাঁচ বছর আগে সেদিন ক্লাস টেস্ট দিয়ে তোর সঙ্গে তোর বাড়ি গিয়েছিলাম নোটস নিতে। তোর বিছানায় পুতুলটা দেখে একটু হাতে নিয়েছি। ওমনি তুই এমন করে কেড়ে নিলি খুব অপমান লেগেছিল। সেদিনই চুরি করেছিলাম ওটা। ভেবেছিলাম তোকে ফেরত দেব। বাসায় এসে দেখি ওটাতে তোর সোনার ব্রেসলেট। ব্রেসলেটসহ পুতুলটা ওভাবেই রেখে দিই। পরের দিন হঠাৎ করে জ্বর আসাতে তোর কাছে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দুদিন পর তোর বাসায় গিয়ে শুনি কাজের মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিয়েছিস এই পুতুল চুরির অপবাদে। লজ্জায় আর ফেরত দিতে পারিনি।
ভাবছিস আজ এত বছর পরে কেন ফেরত দিলাম তাহলে। দেশে ফিরেছি আজ পনেরো দিন হলো। তোর সঙ্গে দেখা করে সারপ্রাইজ দেব বলে আমি আর পূষণ তোর অফিসে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোকে পেলাম না। কী একটা মিটিংয়ে তুই বসের সঙ্গে বাইরে গেছিস। তোর অফিস থেকে বের হয়ে দুজন হাঁটছিলাম। হঠাৎ এক মাঝবয়সী লোক আমাদের সামনে এসে বারবার শুধু বলছিল, একটা পুতুল কিনে দেবে, মা। কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছিল না, বারবার শুধু সেই এক কথা। আমি আর পূষণ কৌতূহল মেটাতে না পেরে লোকটার খোঁজখবর নিলাম। খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম, লোকটার একটা মেয়ে ছিল। মেয়েটির শহরে এক বাসায় কাজ করতে গিয়ে পুতুল চুরির অপবাদ নিয়ে ফিরে এসে আত্মহত্যা করেছিল। এরপর থেকেই লোকটি পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে শুধু একটা পুতুল চেয়ে বেড়ায়।
হঠাৎ করে মনে হলো, পাঁচ বছর আগে আমিও তো তোর পুতুল চুরি করেছিলাম। তোর বাড়ির কাজের মেয়েটা সেই চুরির অপবাদ পেয়েছিল। দেরি না করে জিজ্ঞেস করলাম যে বাসায় কাজ করত সেই মালিকের নাম কী। তোর বাবা অর্থাৎ আঙ্কেলের নাম বলাতে এক মুহূর্ত যেন মনে হলো মাটির সঙ্গে মিশে যাই। একে তো পাঁচ বছর ধরে চুরি করার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। তার ওপর আজ আমার দোষে একটা মেয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিল আর তার বাবা পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিলাম না। এই পাপের উপযুক্ত শাস্তিও হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমায় দিলেন। গতকাল ডাক্তারের রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। আমি আর কোনো দিন মা হতে পারব না। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে বল? তাই ভাবলাম, তোর পুতুল তোকে ফেরত দিই। নিচে ওই পাগল ভদ্রলোকের ঠিকানা দিয়ে দিলাম। যদি পারিস তুইও একবার ক্ষমা চেয়ে নিস।
ইতি,
পাপিষ্ঠা রিমি

প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। চরম প্রতিশোধ। আজ এক মাস হতে চলল আমার মা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। আর বাবা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায়। সেদিন মামিকে দেখে পরের দিন বাড়ি ফেরার পথে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মা স্পট ডেথ আর বাবার মাথায় আঘাত লেগে প্যারালাইজড। রিমির দেওয়া ঠিকানায় পুতুল ফেরত দিতে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম গভীর রাতে হঠাৎ জ্বরে মারা গেছেন সেই পাগল বাবা।
পাঁচ বছর পর সেই পুতুল আবারও আমার বিছানায় সঙ্গী। আগে রঙিন স্বপ্ন চোখে নিয়ে ঘুমাতাম আর এখন দুঃস্বপ্নের পাহাড় নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাই।