শুভবিবাহকাব্য


বসন্ত শুরু হয়েছে। শীত বিদায় নেওয়ার পালা। গাছে গাছে কচি পাতার দর্শন। ফুলরাজি ফুটিফুটি করছে। অনেকের জীবনে বসন্ত আসি আসি।
আমার বন্ধু তোফায়েল। ছোটবেলার বন্ধু। সেই স্কুলজীবন থেকে শুরু, এখনো আছি। ১২ বছর আগে একদিন আমাকে ফোন দিয়ে বলল, ‘কাল ভোরে আমার বাসায় আয়। জাকির হোসেন রোড, মোহাম্মদপুর।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘কেন?’ ও উত্তর দিল, ‘বিয়ে করতে যাব। তোর থাকা খুব প্রয়োজন।’
পরের দিন। ২৯ ফেব্রুয়ারি। যাত্রাবাড়ী থেকে রওনা হয়ে ভোরে আমি উপস্থিত হলাম তোফায়েলের বাসায়। ওকে পাজামা, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, পাগড়ি পরিয়ে নতুন বরের সাজে তৈরি করলাম। আয়োজন খুব বেশি নয়। এ আয়োজন করতেও তোফায়েলকে অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়েছে। দুই পরিবারকে রাজি করাতে হয়েছে, যেহেতু প্রেমের বিয়ে। আমরা রওনা হলাম দুইটা মাইক্রোবাস ও একটা প্রাইভেট কার নিয়ে রানীদের বাড়ির উদ্দেশে। রানী হচ্ছে তোফায়েলের হবু বউ। আমি রানীকে আগে থেকেই চিনতাম। সে নিয়ে আবার অনেক ঘটনা। ওদিকে না যাই। অনেক সময় লাগবে।
ফিরে আসি, যা বলছিলাম। গাড়িতে উঠেই মনে হলো, মালাবদলের ফুল নেওয়া হয়নি। আবার শাহবাগ গাড়ি থামিয়ে লাল টুকটুকে গোলাপ আর শ্বেতশুভ্র রজনীগন্ধার মালা নিলাম এক জোড়া।
হালকা কুয়াশার চাদর। সূর্য তার নরম আলো বিলাচ্ছে। আমরা বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম টঙ্গীবাড়িতে।
বরের স্টেজে বরের পাশে বসা আমি। কনের দিকের অনেকেই আসছে। পরিচয় হচ্ছে। নানা ধরনের কথা বলছে। ঠাট্টার ছলে অনেকেই অনেক ধরনের প্রশ্ন করছে। সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে আমাকে। তোফায়েল মুখে রুমাল দিয়ে বসে আছে।
মধ্যাহ্নভোজ শেষে বিয়েপর্ব। সিরিয়াস বিষয় হচ্ছে, আমি দোস্তের বিয়ের সাক্ষী হলাম। বিয়ের সব আচার শেষ করে নতুন বউ নিয়ে বিকেলে আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম।
শুরু হলো তোফায়েল ও রানীর নতুন জীবন। কয়েক বছর পর। ফোনে জানতে পারলাম, তোফায়েল স্কয়ার হাস্পাতালে ভর্তি। ওর ব্রেন টিউমার হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে। অনেক রক্তের প্রয়োজন। প্লাটিলেট কমে গেছে। অনেক টাকার প্রয়োজন।
কোনো কিছু না ভেবেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। রতন, রায়হান, রানা, শফিকুল, জাকিরকে ফোন দিই। সব বন্ধু যার যার মতো ছুটে আসে ধানমন্ডি স্কয়ার হাস্পাতালে। সে কি অবস্থা! ১০ ঘণ্টাব্যাপী অপারেশন হলো। অপারেশন সাকসেস কি না, ডাক্তার বলেন না। আমাদের কিছু না জানিয়ে ডাক্তার চলে যান। কেউ কিছু বলে না। সবাই ঘুমিয়ে। আমি একা জেগে। রাত তিনটার পর সিস্টার জানান, একজন দেখতে যেতে পারবেন। আমি নিজে যেতে পারতাম। ভাবলাম, না ওর মায়ের দেখাটা সবার আগে। ওর মাকে ডেকে দেখার ব্যবস্থা করে দিলাম। পরদিন ডাক্তার জানালেন, ৩৬ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাবে না। কয়েক রাত হাসপাতালে নির্ঘুম কাটল। আমরা বন্ধুরা পরিশ্রম দিয়ে, টাকাপয়সা দিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম ওর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। প্রাণের বন্ধু মারা যাচ্ছে, নিশ্চিত। আমাদের চোখে জল।
মহান স্রষ্টার অসীম মেহেরবানিতে তোফায়েল ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকল। ডাক্তার জানালেন, ওর বেঁচে থাকাটা নাকি অবিশ্বাস্য। আজ ও সম্পূর্ণ সুস্থ। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। বন্ধু তুই বেঁচে থাক হাজার বছর। ফোনে হোক, দেখা হোক, শত ঝগড়া করেই বেঁচে থাকিস তুই।
বর্তমানে তোফায়েল ও রানীর এক মেয়ে এক ছেলে। তোফায়েল বিকাশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মিরপুরে নিজের ফ্ল্যাট। নিজের গাড়ি। সুখের সংসার। প্রতি লিপিয়ারে, অর্থাৎ চার বছর পরপর ধুমধামের সঙ্গে বিবাহবার্ষিকী পালন করে। আমাকে দাওয়াত করে।
বারিধারা, ঢাকা।