তানজিনা যেভাবে সুপারহিরোইন


তানজিনাদের মরিচবাগান বৃষ্টিতে ভেসে গেছে। ফোনে যখন এই খবরটা ভেসে এল, তানজিনা তখন ঢাকার কোনো এক সুউচ্চ অট্টালিকার বারান্দায় সেই একই বৃষ্টির ছাট মাখছিল গালে। মনে পড়ছিল তার ফেলে আসা গ্রামের কথা।
বর্ষায় তাদের ঘরের পেছনের ডোবা থেকে ভেসে আসে ব্যাঙের ডাক। সারা রাত বালিশে মাথা রেখে সেই ঘ্যাঙর ঘ্যাঙরের কত কী মানে করত সে। ভাবত পাস করে ঢাকার কোনো একটি কলেজে ভর্তি হবে।
এখন ঢাকা থেকে ঝুম বৃষ্টি হলে ভাবে, এবার গ্রামে গেলে আর ফিরবে না। মানুষের চাওয়াগুলো এত অদ্ভুত হয়! যা নেই, তার জন্য হাহাকার।
বিদেশি এক অসুখ এসেছে দেশে। সবাইকে দূরে যেতে বলছে। এই দূরে থাকলেই নাকি কাছে থাকা হবে। আগে খুব সামাজিক যোগাযোগ কথাটি শোনা যেত। এখন শোনা যায় সামাজিক দূরত্ব। তানজিনা হাসে। ভাবে, এ ভারি মজা হলো। পৃথিবীজুড়ে যে যুদ্ধ, পারমাণবিক বোমার বাহাদুরি—সবই তো দেশ থেকে দেশের, মানুষ থেকে মানুষের দূরে যাওয়ার ইচ্ছা। কে জানে বিদেশি অসুখ সেই রসিকতাটুকুই করার চেষ্টা করছে কি না!
মানুষ এখন ক্রিকেটের স্কোর দেখার মতো করোনার আপডেট দেখে। কতজন আক্রান্ত হলো। কতজন মারা গেল। কতজন সুস্থ হলো। কোন এলাকা লকডাউন করা হলো।
বেলা ১১টার মতো বাজে। তানজিনা পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাকার এই বাসাটায় নার্সের কাজ করে। বিল্ডিংয়ের বারান্দা থেকে মেইন রোড দেখা যায়। একটা লোক অনেকক্ষণ ধরে রাস্তায় পড়ে আছে। একটা-দুটো রিকশা চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। দু-একজন পথচারী দেখেও আবার দূরে চলে যাচ্ছে। হয়তো করোনায় আক্রান্ত ভেবে কেউ কাছে যাচ্ছে না!
তানজিনা বারান্দা থেকে দ্রুত রুমে গেল। বাসার লোকজনের উদ্দেশে একটা চিরকুট লিখে দ্রুত লিফটে উঠল। বের হওয়ার আগে পরে নিল মাস্ক ও গ্লাভস।
দূর থেকে কয়েকজন লোক রাস্তার পাশে পড়ে থাকা লোকটিকে দেখছিল। তানজিনাকে তার কাছে যেতে দেখে লোকগুলো হইহই করে উঠল, কাছে যাবেন না, আপা।
তানজিনা পড়ে থাকা লোকটিকে কাছে দাঁড়িয়ে দেখল। সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে আছে। সে হাঁটু গেড়ে বসে লোকটির পালস দেখল। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া দরকার। কয়েকটি রিকশা ডেকেও লাভ হলো না। কেউ যাবে না।
শেষমেশ একটা ঠেলাগাড়ি করে তানজিনা লোকটিকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটল।
এর দুই ঘণ্টা পর অনলাইন পত্রিকার একটি নিউজের শিরোনাম:
রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ লোককে ঠেলাগাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন জনৈক তরুণী।
তার ৪৮ ঘণ্টা পরের শিরোনাম:
রাস্তায় পড়ে থাকা লোকটি করোনা পজিটিভ। তাকে উদ্ধার করা তরুণীর সেই হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগদান।
তারও ছয় মাস পরের এক রোদ-ঝলমলে দিন। সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য তানজিনাকে সুপারহিরোইন খেতাব দেওয়া হয়েছে। সেই হাসপাতাল বলেছে, তারা তানজিনার পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে চায় এবং তাদের নিয়মিত নার্স হিসেবে নিয়োগ দিতে চায়।
তানজিনা তখন এই সব কোলাহল থেকে অনেক অনেক দূরে। গ্রামের বাড়ির উঠানে অসুস্থ বাবাকে চায়ে ডুবিয়ে বিস্কুট খাওয়াচ্ছে। তার বাবা সেই বিস্কুট খুব মন দিয়ে খাচ্ছেন।
একটা বিস্কুট মুখে তুলে দেওয়ার আগেই ভেঙে পড়ে গেল। তানজিনার বাবা বললেন, এহ হে!
তানজিনা ও তার বাবা দুজনেই হেসে উঠলেন। বিশ্বাস ও ভালোবাসামাখানো সে হাসি।