যেমন দেখেছি জামিলুর রেজা স্যারকে

জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী


সংবাদটি প্রথমে ফেসবুকে দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশন ছাড়লাম। স্ক্রলে ভেসে উঠল জামিলুর রেজা চৌধুরী আর নেই। স্যারকে প্রথম দেখা আর শেষ দেখার মধ্যে সময়ের ব্যবধান সাত-আট বছর।
স্যারের জীবনে এক আশ্চর্য রকমের ছন্দ ছিল বলেই আমার সব সময় মনে হয়েছে। চোখের সামনে এখনো খুব ভাসে স্যারকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম আর শেষ যেদিন দেখেছিলাম, এই দুই দেখার মধ্যে তেমন পার্থক্য ছিল না। সাধারণত মানুষের বয়সের সঙ্গে শরীর, চেহারা ও মানসিকতার পরিবর্তন হয়। স্যারকে সব সময় দেখেছি চিরসবুজ এক মানুষ। কথা বলা, হাঁটাচলা—সবকিছু যেন একই ছন্দে।
প্রথম আলোর অনেক গোলটেবিল বৈঠকে স্যারকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। গভীরভাবে তাঁর আলোচনা শুনেছি। গণিত অলিম্পিয়াডসহ প্রথম আলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্যারের কথা শুনেছি। অনেকের কাছে তাঁর গল্প শুনেছি ও তাঁকে নিয়ে লেখা পড়েছি। জামিলুর রেজা স্যারকে আমার এভাবেই জানা।
আর এমনি করেই জেনেছি, স্বাধীনতার পর থেকে দেশের সব বড় নির্মাণ প্রকল্প স্যারের তত্ত্বাবধানেই হয়েছে। তিনি দেশের প্রথম দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতুর পরামর্শক ছিলেন। তারপর আরও দীর্ঘতম পদ্মা বহুমুখী সেতুর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞমণ্ডলীর প্রধান ছিলেন। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, কর্ণফুলী নদীর সুরঙ্গ, ঢাকা–আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের পরামর্শক ছিলেন। আমরা হয়তো জানি না, এমন আরও ছোট-বড় অনেক প্রকল্প, সংগঠন ও সংস্থায় যুক্ত ছিলেন স্যার।
একজন মানুষ এত কিছু করার পর কীভাবে এত প্রাণবন্ত থাকেন, এটা একটা বিস্ময়।

স্যার আসলে জীবনকে সাজিয়েছিলেন সময়ের ফ্রেমে। নিয়ম করে প্রায় দুবেলা হাঁটতেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। খাওয়া, ঘুম, কাজ—সবকিছুর মধ্যে একটা পরিকল্পিত জীবনের সমন্বয় ছিল।
প্রথম আলোর শুরু থেকে বন্ধুসভার সঙ্গে আছি, কিন্তু গোলটেবিল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পথচলা প্রায় আট বছর। এই দীর্ঘ সময়ে জামিলুর রেজা স্যার বেশ কয়েকবার গোলটেবিল বৈঠকে এসেছেন। এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না কতটি হবে। তবে ঠিক যে সংখ্যাটা কম হবে না।
প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকগুলো বিভিন্ন শিরোনামে বিভিন্ন বিষয়ে হয়ে থাকে। এর মধ্যে কোনো কোনো আলোচনা অনুষ্ঠানে স্যারকে আমরা আমন্ত্রণ জানাতাম। তিনি আলোচনায় আসতেন। গোলটেবিল বৈঠকে সাধারণত বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলোচকেরা থাকেন। বিভিন্ন পরিস্থিতির জন্য নির্দিষ্ট সময়ের পরও অনেকের জন্য কিছুটা অপেক্ষা করতে হয়।
তবে যত দূর মনে পড়ে, স্যারকে কখনো দেরি করে অনুষ্ঠানে আসতে দেখিনি। প্রথম আলো থেকে যখনই আমরা স্যারকে ফোন করতাম, অধিকাংশ সময় তিনি ফোন ধরেছেন। কখনো না ধরতে পারলে মেসেজ করে জানিয়েছেন। প্রতিটি বিষয়ের দিকে স্যারের মনোযোগ দেখে খুব অবাক হতাম।
গত ১৯ নভেম্বর তিনি এসেছিলেন। এটাই ছিল তাঁর প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠকে শেষবার আসা। এ আলোচনার শিরোনাম ছিল ‘ঢাকা মহানগরীতে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সন্ধানে’। স্যার ছিলেন বুয়েটের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। স্যারের উদ্যোগে বুয়েট অ্যালামনাই ও প্রথম আলো এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। এখনো মনে পড়ে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র তখন অনেক ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু শুধু স্যারের সম্মানে অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও সেদিন তিনি গোলটেবিলে উপস্থিত ছিলেন।

আমরা তো জানি যে স্যার একজন প্রকৌশলী ছিলেন। এর বাইরেও তিনি বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা, যানজট, পরিবেশবান্ধব নির্মাণ, নির্মাণ বিধিমালা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ঢাকার চারপাশের নদী রক্ষা, জলাশয় রক্ষা, ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানসহ (ড্যাপ), অনেক বিষয় নিয়ে স্যার আলোচনা করতেন। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তিনি অনেক বেশি চিন্তা করতেন।
স্যারকে দেখে কখনো মনে হতো না যে মানুষটি রাগতে পারেন। সব সময় বেশ বিনয়ী ও মিষ্টভাষী ছিলেন। অধিকাংশ সময় স্যারকে সাদা হাফ শার্ট পরতে দেখেছি। হাফ শার্টে তাঁকে আরও প্রাণবন্ত মনে হতো। স্যারকে প্রথম যখন গোলটেবিলে দেখেছি, তখন তাঁর বয়স হবে প্রায় ৬৯ বছর। আর শেষ তিনি গত নভেম্বরে এসেছিলেন। এ সময়ের দূরত্ব প্রায় আট বছর। আজ এ লেখার সময় মনে পড়ছে জীবনানন্দ দাশের সেই ‘আট বছর আগের এক দিন’ শিরোনামের কবিতার কথা। কবিতাটিতেও একটি মৃত্যুর ঘটনা ছিল।
স্যারকে নিয়ে আমার নিজের একটু অভিজ্ঞতাও রয়েছে। সেই শুরু থেকেই একটা বিষয় দেখে আসছি, স্যার যতবারই গোলটেবিল আলোচনায় এসেছেন, সবাই তাঁকে স্যারই বলেন। যাঁদেরকে বেশ সিনিয়র মনে হয়েছে, তাঁদেরকেও স্যার বলতে শুনেছি। স্যার অনুষ্ঠানে এলে এগিয়ে নিয়ে আসতাম। আবার অনুষ্ঠান শেষে কিছুটা এগিয়ে দিতাম।
প্রশ্নটা একটু সিলি হলেও একদিন স্যারকে বলেই ফেললাম, ‘স্যার, গোলটেবিলের সব লোকই আপনাকে স্যার বলেন। এ পর্যন্ত একজনকেও দেখেনি যে স্যার ছাড়া অন্য কিছু বলেছেন।’ উত্তরে স্যার বলেছিলেন, শুধু দেশে না, বিদেশে গেলেও এমন হয়।
দেশ-বিদেশে সর্বজন শ্রদ্ধেয় এমন একজন মানুষকে আমরা হারালাম, আমাদের জীবনে হয়তো এমন মানুষ আর পাব না।

আরেকবার প্রথম আলোর মাসিক বিজ্ঞানচিন্তার একটি সংখ্যার প্রচ্ছদে স্যারের ছবি ছাপা হয়েছিল। এই প্রচ্ছদটি আমার ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। স্যার একটি টেক্সট করে জানতে চেয়েছিলেন, ছবিটি তিনি নিতে পারেন কি না। এটি ছিল আমার জীবনে এক বিস্ময়কর না ভোলার মতো ঘটনা। সাধারণত মানুষ কোনো ছবি ভালো লাগলেই নিয়ে নেয়, কিন্তু প্রচ্ছদে স্যারের ছবি। তিনি নেবেন। তারপরও তিনি অনুমতি চেয়েছেন।
সেদিন মনে হয়েছিল, মানুষ যে বড় হয়, সম্মানিত হয়, সাবই তাকে শ্রদ্ধা করে, সেটা এমনিতে না। সেই মানুষটির এমন কিছু বিষয় থাকে, যা প্রত্যেককে মুগ্ধ করে। স্যারের কথা শুনে কখনো মনে হয়নি তিনি কোনো দলমতের ছিলেন। তিনি ছিলেন সবার কল্যাণের, মানবিকতার ও সত্য-সুন্দরের। স্যারের সব চিন্তা ও পরিকল্পনায় থাকত দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি।
স্যারের তো বহুমাত্রিক পরিচয়। ১৯৯৬ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি, খনিজ ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা (মন্ত্রী) ছিলেন। তিনি জাতীয় অধ্যাপক। ব্র্যাক ও সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ছিলেন। পেশাজীবনের শুরুতে বুয়েটে অধ্যাপনা করেছেন। ছিলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি। আরও সংগঠন ও সংস্থার সঙ্গে স্যার যুক্ত ছিলেন, যা আমরা হয়তো জানি না।
আমরা জানি, একজন জামিলুর রেজা স্যার বারবার আসবেন না। মৃত্যু অনিবার্য বলেই হয়তো মানুষ জীবনকে এত ভালোবাসে। তবু আমাদের এমন প্রিয় কেউ থাকেন, যাঁদের ক্ষেত্রে এই অনিবার্য মৃত্যুও মেনে নেওয়া কষ্টকর।
স্থপতি কাজী এম আরিফের ‘আলোর পথযাত্রী’ শিরোনামে একটা লেখায় দেখলাম, মৃত্যুর মাত্র ১৫ ঘণ্টা আগে স্যারসহ ৭ জন করোনা নিয়ে জুমের মাধ্যমে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। জীবন ও পৃথিবীর কত রহস্য! মাত্র ১৫ ঘণ্টা আগে যিনি ছিলেন এই গ্রহের সুস্থ–প্রাণবন্ত একজন মানুষ, ১৫ ঘণ্টা পরেই সেই মানুষটি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শুধু এটুকু বলি, স্যার আপনার এ এক অনন্ত যাত্রা। এর তো শেষ নেই। শুধু এটুকু প্রার্থনা করি, যেখানে থাকুন শান্তিতে থাকুন।

সাংবাদিক ও সংগঠক