রবীন্দ্রনাথের চোখে নারী


বাঙালির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে মাথা নেড়ে নেড়ে, ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ কেউ আবার বাবার সঙ্গে সুর মিলিয়ে গেয়েছি, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান, শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো তিন কন্যা দান।’
তারপর আরেকটুকু বড়বেলায় রবিঠাকুর আসেন ফটিকের মর্মান্তিক করুণ প্রয়াণে। এভাবেই আমাদের জীবনের বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ এসেছেন বিভিন্নভাবে। যখন কোনো অজানা ব্যথায় কাতর হয়েছি, তখন চোখ বন্ধ করে ‘যদি জানতেম আমার কিসের ও ব্যথা, তোমায় জানাতেম’ নিজের মনে গেয়ে গেয়ে সান্ত্বনা খুঁজেছি। ভালোবাসার মানে খুঁজে না পেয়ে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিয়েছি ‘সখী ভালবাসা কারে কয়’ গানে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জীবনে নানা দিক থেকে এত প্রভাব বিস্তার করে রয়েছেন, যা ভাবতেই অবাক লাগে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাই এক শ। মানুষের জীবনের এমন কোনো অনভূতি, আবেগ, সুখ-দুঃখ নেই, যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখে যাননি। রবীন্দ্রনাথ বিরাজ করছেন আমাদের অন্তরে, বাহিরে সর্বত্র।
তবে মানুষের জয়গান গাওয়া এই সাহিত্যিকের অন্যতম পরিচয় নারী জাগরণ। উনিশ শতকে নারীর অধিকার যখন অনেকটাই অকল্পনীয়, তখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নারীকে তুলে এনেছেন তাঁর লেখনীর কেন্দ্রীয় চরিত্রে। নারীকে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা, সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ও সাহসী হিসেবে।
শাস্ত্রে মেয়েদের বলা হয় ‘পূজার্হা গৃহদীপ্তয়’। কিন্তু রবীন্দ্রচেতনায় নারীকে গৃহলক্ষ্মীর সম্মানে অধিষ্ঠিত দেখার চেয়ে পুরুষের হৃদয়েশ্বরীরূপে দেখার প্রবণতা বেশি। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকেরা নারীকে তাঁদের কাব্য প্রেরণার অংশ করেছেন, তাঁদের মধ্যে আপন মানসীকে প্রত্যক্ষ করেছেন; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত কেউই নারীকে আত্মস্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করে প্রকাশ করেননি।
রবীন্দ্রনাথ নারীকে এঁকেছেন শব্দ তুলির হরেক আঁচড়ে। কখনো সেই নারী সুখে বহুবর্ণা উজ্জ্বল, কখনো দুঃখে সাদা–কালো-মলিন, কখনোবা ধূসর জীর্ণ। তবে যা–ই হোক না কেন, সবটুকুই তাঁরই আবিষ্কার। সেই আবিষ্কার রবীন্দ্রমনের, রবির কিরণের ঝলকানিতে। তিনি তো বলেছেনই:

আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা
তুমি আমারই, তুমি আমারই মম জীবন-মরণ বিহারী।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা