গল্পের শহরে


শুরু হচ্ছে ২০৩০ সালের ঢাকা শহরের এক কর্মমুখর দিন। খোলা জানালা গলে সকালবেলার মিষ্টি রোদ ঢুকে পড়েছে পিয়ানিদের ঘরে।
পিয়ানির বাবার সকাল শুরু হয় তিন ‘চ’ দিয়ে। চিরতার পানি, চুমু আর চা। সকাল সকাল পিয়ানির মা চিরতার পানিভর্তি গ্লাস বাড়িয়ে দেন তাঁর দিকে। এক চুমুকে সেই পানীয় গিলে স্ত্রীকে কাছে টেনে নেন তিনি।
এই পর্যায়ে দ্বিতীয় চ–এর কাজ সম্পন্ন হয়। পিয়ানির মা সেই ‘কর্ম’ কোনো রকমে সামলে বলেন, প্রতিদিন এই জিনিস খেয়ে কী মজা পাও কে জানে! পিয়ানির বাবার ঠোঁটে হাসি ফোটে। তিনি বলেন, কোন জিনিসের কথা বলছ—প্রথমটি নাকি দ্বিতীয়টি? পিয়ানির মা-ও কম যান না, বলেন, দুটো তো একই, চিরতার পানি!
অতঃপর কোনো সাংসারিক কথাবার্তা না থাকলে টেবিলে এক কাপ ধূমায়িত চা রেখে পিয়ানির মা চলে যান। পিয়ানির বাবা গরম চায়ের কাপে সাবধানী ঠোঁট রেখে অফিসের কাজ শুরু করেন।
আজও তিনি সেভাবেই অফিস শুরু করলেন। পিয়ানি এসে বসেছে তার বাবার পাশে। পিয়ানির বয়স ১২ বছর। সে পড়ে ক্লাস সিক্সে। আজ তার স্কুলে যেতে হবে। প্রতিদিন সে তার রিডিং রুমে বসে ক্লাস করে। অনলাইনে। মাসে এক দিন ক্লাসে যেতে হয়। সে শুনেছে আগে সবাইকে প্রতিদিন ক্লাসে যেতে হতো। পিয়ানি তো এটা ভাবতেই পারে না। প্রতিদিন ক্লাসে যেতে তার সমস্যা নেই। সমস্যা অন্য জায়গায়।
মা তাকে স্কুলে নিয়ে যান। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। ঘুম থেকে উঠেই সেদিন তার মায়ের প্রস্তুতি শুরু হয়। সাজগোজে চলে যায় এক–দেড় ঘণ্টা।
পিয়ানি তার বাবাকে বলল, মা কিন্তু আমাদের জন্য কখনো সাজেন না বাবা! পিয়ানির বাবা বললেন, সত্যি? পিয়ানি বলল, হুম, মা ঘরে শুধু টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে থাকেন। অথচ বাইরে গেলে কত সুন্দর করে শাড়ি পরেন। চোখে কাজল দেন। শুনে তার বাবা হাসেন।
পিয়ানিকে কাছে টেনে বলেন, কয়েক বছর আগেও কিন্তু আমাদের নিয়মিত বাইরে যেতে হতো। তাই সেই আমলের আমাদের কাছে এখন বাইরে যাওয়া মানেই বিশাল ব্যাপার। বেড়াতে যাওয়ার মতো। তোর মায়ের সাজগোজটা হয়তো সে জন্যই।
পিয়ানি বলে, এখন কেন আমরা বাইরে বেশি যাই না বাবা? পিয়ানির বাবা বলেন, আজ থেকে আট–দশ বছর আগে হঠাৎ করেই এক মহামারিতে স্থবির হয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্ব। ঘরের বাইরে গেলেই লোকে রোগে সংক্রমিত হতো। তারপরের পৃথিবী গল্পের মতোই বদলে গেছে। আমরা এখন বাসায় বসে অফিস করি। ভিডিও কনফারেন্সে চলছে স্কুল–কলেজের ক্লাস, চিকিৎসা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ওষুধ ও পোশাক কিনছি অনলাইনে। সাজসজ্জা, চুল কাটার মতো কাজও আমরা এখন নিজেরাই ঘরে বসে করছি।
পিয়ানি বলল, হুম। এমন সময় পিয়ানির মা এসে তাকে তাড়া দিলেন, চল বের হই, তোর স্কুলের সময় হয়ে গেছে। পিয়ানি মায়ের দিকে তাকিয়ে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। মাকে আজ কী যে সুন্দর লাগছে!
পিয়ানিরা আজ গাড়ি নেবে না। মাঝে মাঝে তারা রিকশায় স্কুলে যায়। রিকশা তার ও তার মায়ের ভারি পছন্দ।
রিকশায় বসে পিয়ানির মা বললেন, আগে এই রাস্তায় রিকশা–গাড়িতে জ্যাম লেগেই থাকত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ সেই জ্যামে বসে থাকত। ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারত না।
পিয়ানি কিছু বলল না। সে এক হাতে খামচে ধরে আছে মায়ের নরম ঊরু। মা তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। মায়ের গা থেকে ভেসে আসা মিষ্টি সুবাসে বুঁদ হয়ে চারপাশ দেখছে পিয়ানি।
তারা যাচ্ছিল সাতমসজিদ রোড ধরে। নিরিবিলি ছিমছাম শহর। পথের পাশে ফুটে আছে হলুদ সোনালু ফুল। পিয়ানির কী যে ভালো লাগছে বলার মতো না।
এমন সময় একটা ঘটনা ঘটল।
একটা কালো রঙের মাইক্রোবাস এসে তাদের রিকশার ঠিক সামনে হার্ড ব্রেক করল। রিকশা থেমে গেল। কিছু বোঝার আগেই মাইক্রোবাস থেকে অস্ত্রসহ কিছু লোক নেমে এসে তাদের ঘিরে ধরল। পিয়ানি হতবাক। পিয়ানির মা কোনো মতে বলতে পারলেন, কী হচ্ছে, কী হচ্ছে?
তাদের তুলে নিয়ে দ্রুত বেগে ছুটতে লাগল মাইক্রোবাস। পিয়ানির মা নিশ্চুপ। আতঙ্ক আর হতাশায় নেয়ে ঘেমে একাকার। তাদের সঙ্গের ব্যাগ মোবাইল সবই নিয়ে নেওয়া হয়েছে। পিয়ানি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তার একটা হাত তার মায়ের ঊরুতে।
মায়ের জন্য তার চিন্তা হচ্ছে। মা খুব ভয় পেয়ে একদম চুপ করে আছেন। একসময় শুনতে পেল, তাদের দুই পাশের একজন ফোনে বলছে, ওস্তাদ কন্যাসহ রাজকুমারী, ওন দা ওয়ে। লোকটা কী বোঝাতে চেয়েছে সেটি পরিষ্কার। তারা কিডন্যাপড। পিয়ানি অনুমান করছে, তারা শহর থেকে প্রায় বের হয়ে যাচ্ছে। দুষ্ট লোকগুলোকে এখন অনেকটাই নির্ভার দেখাচ্ছে।
পিয়ানি এবার ঠান্ডা মাথায় কাজটা করল। সন্তর্পণে মায়ের ঊরু থেকে তার ডান হাত নিজের ঊরুতে নিয়ে এল। দৃষ্টি গাড়ির কালো কাচে রেখে সেই হাত খুব সাবধানে ঊরুর নিচের দিকে নিয়ে সেখানে বাঁধা একটা সুইচ টিপে দিল। খুব আস্তে একটা শব্দ হলো।
এবার পিয়ানিও নির্ভার। সামনের সিটে বসা লোকটি পেছনে তাকিয়ে পিয়ানিদের উদ্দেশে বলল, সিস্টার সমস্যা হলে বলবেন। পিয়ানির মা চুপ করে আছেন। সুযোগটা কাজে লাগাল পিয়ানি। বলল, আমি ওয়াশরুমে যাব।
পিয়ানিরা এখন একটা ফিলিং স্টেশনের ওয়াশরুমে। বাইরে গাড়ি রেখে পাহারায় আছে লোকগুলো। পিয়ানি তার মাকে ওয়াশরুমের একেবারে ভেতরের দিকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ভয় নেই মা। ঊরুতে বাঁধা যন্ত্রটা সাবধানে খুলে মাকে দেখাতে লাগল সে, এটা অনেকটা মোবাইলের মতো। লোকেশন অন করা আছে। এমনকি এখানকার সাউন্ডও চলে যাচ্ছে তিনটা জায়গায়। এই যন্ত্র স্কুল থেকে আমাদের দিয়েছে। নিরাপত্তার জন্য। আমি একটু আগে এটি চালু করে দিয়েছি। এসএমএস চলে গেছে আমার স্কুলে, পুলিশের কাছে আর বাবার কাছে। পিয়ানির মা বিস্মিত। তারপর পিয়ানি যন্ত্রটির আরেকটি বোতাম টাচ করল। একটা স্ক্রিন ভেসে উঠল। তারা সেখানে দেখতে পেল তাদের উদ্ধারের জন্য পুলিশের যে গাড়িটি তাদের অনুসরণ করছে, সেটি আর মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে।
ওয়াশরুমে বেশি সময় ব্যয় করতে পারল না পিয়ানিরা। লোকগুলো তাড়া দিয়ে তাদের আবারও মাইক্রোবাসে তুলে নিল। তবে পিয়ানি এখন আসলেই নিশ্চিন্ত। কারণ, মা আর টেনশন করছেন না।
পিয়ানির মজাই লাগছে। সে একবার এ রকম একটা সিনেমা দেখেছিল।