প্রকৃতির জন্য কি আশীর্বাদ?


জীবনযাত্রাকে থমকে দেওয়া করোনাভাইরাস প্রকৃতিতে যেন আশীর্বাদই হয়ে এসেছে। ব্যস্ত নগরের আকাশে খেলা করছে নীল ও সাদা মেঘ, রাতের আকাশে মিটি মিটি করে জ্বলছে তারকারাজি। গাছে গাছে ফুটেছে মনমাতানো হরেক রকমের ফুল। গাছের মগডালে বসে ডাকছে কোকিল ও ঝিঁঝি পোকা। এ যেন সত্যিই বাংলার চিরাচরিত রূপ। যা এক সময় শুধু উপভোগ করেছে গ্রামবাংলার মানুষ। নগরবাসীর আত্মোপলব্ধিকে জাগিয়ে তোলার এ অপার কৌশল প্রকৃতি দেবীর। তাই প্রকৃতি নিজের সুষমা, সৌন্দর্যরাশি যেন একের পর এক তুলে ধরেছে।
লকডাউন শুরুর পর থেকে পর্যটকবিহীন সুন্দরবন। বন বিভাগ জানাচ্ছে, সুন্দরবনে মুক্তির আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ ও অন্যান্য বন্য প্রাণী।
বরফে ঢাকা উত্তর মেরুর আকাশে ওজোন স্তরে ১০ লাখ বর্গকিলোমিটারের একটি বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছিল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর ওজোনে এ গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় ভয়াবহ আশঙ্কার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। এ গর্তের ফলে সরাসরি হুমকির মুখে পড়ত পৃথিবীবাসী। বিশ্বব্যাপী চলা লকডাউনে ওজোন স্তরের সেরে ওঠার বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। সেই গর্ত নিজে থেকেই আবার সারিয়ে তুলেছে পৃথিবী।
পর্যটক শূন্য সেন্ট মার্টিনের বালুচরে যেন কচ্ছপ ছানাদের মেলা বসেছে। ডিম ফুটেই সাগরে ভেসে চলেছে সদ্য জন্ম নেওয়া ছানারা। অথচ কদিন আগেও এমনটা দেখা যায়নি। এদিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কাছে অনেক বছর পর গোলাপি ডলফিনের একটি দলকে সাগরের নীল জলে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলায় মেতে উঠতে দেখা গেছে। তেমনি পর্যটকবিহীন কুয়াকাটা সৈকতে দেখা গেছে লাল কাঁকড়ার নয়নাভিরাম মিছিল।
এশিয়ার অন্যতম প্রধান মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীর দূষণ কমে এসেছে এই লকডাউনে। আশা করা হচ্ছে, এবার হালদায় ডিমের উৎপাদন বাড়বে।
শুধু বাংলাদেশ কেন। করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় গৃহীত লকডাউন সারা বিশ্বের প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর বেশ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ ও বিভিন্ন দূষণ কমার পাশাপাশি প্রকৃতি ও পরিবেশে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে এই লকডাউন। ভারতে কয়েক যুগ পর কচ্ছপ সাগর থেকে উঠে এসেছে ডিম পাড়ার জন্য। ৬০ বছর পর ইতালির ভ্যানিস নদীতে বুনো রাজহাঁস ফিরে এসেছে, এসেছে ডলফিনও কয়েক দশক পরে। চীনে সাগর থেকে ডলফিন নদীতে প্রবেশ করেছে ৪০ বছর পর। ইউরোপের রাস্তায় বন্য প্রাণী বের হতে শুরু করেছে, বহু বছর পর।
পৃথিবীর বেশি ভাগ দেশের মানুষই এখন ঘরে আছে। যানবাহন, বিমান চলাচল বন্ধ, কলকারখানার চাকা বন্ধ। কার্বন নিঃসরণ কমে গেছে, কয়েক মাস এ অবস্থায় থাকলে তাপমাত্রা কমবে, মেরুর গলে যাওয়া বরফ রক্ষা পাবে।
মানুষ তার অপরিণামদর্শী উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে, অন্যান্য প্রাণিকুলকে অস্তিত্বের ঝুঁকিতে ফেলেছে।
করোনা মহামারি থেকে বেঁচে গেলে পৃথিবীর মানুষের উচিত হবে পরিবেশের দূষণরোধ ও হারিয়ে যাওয়া ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
আজ থেকে সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি, আগামীর দিনগুলোতে কোনো রকম পরিবেশের উপাদান আমাদের দূষণের শিকার হবে না। কোথাও ঘুরতে গেলে বিশেষ করে নদী কিংবা সমুদ্র অঞ্চলে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলব না।
নদী বা সমুদ্র দূষিত হলে, প্রকৃতি দূষিত হলে প্রকৃতি নিজেই আমাদের ওপর প্রতিশোধ নেবে। ওয়ান টাইম প্লাস্টিক ব্যবহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনব আমরা নিজেদের ভবিষ্যতের স্বার্থে।
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুন্দর বাসযোগ্য একটা পৃথিবী উপহার হিসেবে রেখে যাওয়ার প্রত্যয় আমাদের বৈশ্বিকভাবে ধারণ করতে হবে। নয়তো পৃথিবী নামক এই সবুজ গ্রহের ধ্বংসের জন্য আমরা নিজেদের ক্ষমা করতে পারব না।
চট্টগ্রাম বন্ধুসভা