নতুন দিনের প্রত্যাশা

সুমন আনোয়ার পরিচালিত গুলবাহার নাটকে ইরেশ যাকের ও তিশা
সুমন আনোয়ার পরিচালিত গুলবাহার নাটকে ইরেশ যাকের ও তিশা

প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের অয়োময় নাটকটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের ধরতে সুবিধা হবে। এই ধারাবাহিকে মির্জা সাহেবের (জমিদার) মা তাঁর বিছানায় বসে আছেন। গাতক কাশেমের দুই কইন্যা এসেছে জমিদারবাড়ি দর্শনে। তখন মির্জার মা জিজ্ঞাসা করেন, ‘কাশেমের মেয়েরা এই বাড়িতে কী চায়?’ তখন কাজের মহিলা জানান, তারা জমিদারবাড়ি ঘুরে দেখতে এসেছে। জমিদারমাতা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘এরারে ফুলের বাগান দ্যাখাইয়া লাভ কী? এরা ফকিন্নি, এরারে কচুখেত দেখাও।’
কথাটা এ জন্য পাড়লাম যে ২০০০ সালের গোড়ার দিকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এক নতুন কায়দা আবিষ্কার করলেন। কায়দাটা হলো অভিনয়শিল্পীদের সরাসরি সংলাপ পড়তে দেওয়া হবে না। তাঁদের সংলাপের পেছনের ভাবনা বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তাঁরা তাঁদের মতো করে সংলাপ বলবেন। এতে অভিনয় বিষয়টা অনেক স্বতঃস্ফূর্ত হবে। প্রথম দিকে সত্যি বিষয়টা কার্যকর হয়। দর্শক নতুন এই পদ্ধতি দেখে আনন্দ পেতে থাকলেন। আমরাও সাধুবাদ জানালাম ফারুকী ভাইকে। কিন্তু তিনি হয়তো জানতেন না, নিজের অজান্তেই কী বিষবৃক্ষ রোপণ করে ফেলেছেন। সত্যি, এরারে গোলাপবাগান দেখানো উচিত না। পরবর্তী সময়ে এবং এখন এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে নাট্যনির্মাতা আর লেখকদের (কতিপয়) জাতীয় কর্ম। কারণ, অনেক মাথা খাটিয়ে লেখালেখির কী দরকার? যখন যা মনে আসবে, তা-ই বলে যাব। তাতে গল্প, চরিত্র, বিষয়বস্তু ইত্যাদি গোল্লায় গেলে কার কী এসে-যায়? অনেক কিছুই এসে-যায়।
নিজেদের নিজে ফাঁকি দেওয়াই বোধ হয় টিভি নাটক থেকে দর্শকদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অন্যতম কারণ। যত্নের অভাব ও বাজেটের অপ্রতুলতাই বোধ করি নাটকের মান এবং নাটকের পেছনের মানুষের মন বিষিয়ে তুলেছে। চারদিকে সবকিছুর বাজারমূল্য যখন আকাশচুম্বী, তখন একটা জিনিসের দামই দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। আর তা হলো টিভি নাটক। সস্তার তিন অবস্থা—এ কথাটা বর্তমান সময়ের নাটকের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রযোজ্য। আমি এ রকম অসংখ্য নির্মাতা, অভিনেতাকে চিনি, যাঁরা বছরের পর বছর নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে টেলিভিশনের জন্য একটি এক পর্বের নাটক নির্মাণ করে আসছেন। হয়তো নাটকটি যথেষ্ট মানসম্পন্ন হয়ে উঠছে। কিন্তু যখন এটি প্রচারিত হচ্ছে, তখন বিজ্ঞাপনের দোর্দণ্ড প্রতাপে সেটির গল্প আর গল্পের জায়গায় থাকছে না। ওই মেধাবী নির্মাতা হয়তো কিছু বন্ধু নিয়ে নিজের কম্পিউটারে নাটকটি দেখে আত্মতৃপ্তি পেয়েও থাকতে পারেন।
যখন ২০০০ সালের দিকে টিভি নাটক বানানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হলাম, তখন শুনতাম, বিটিভিতে এক মিনিট বিজ্ঞাপন দিতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা গুনতে হতো। আর এখন একটি প্রাইভেট টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পাঁচ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার বেশি লাগে বলে মনে হয় না। যার ফলাফল নাটক ২০ মিনিট হলে বিজ্ঞাপন ৩৫ মিনিট। কার এত ঠেকা পড়েছে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে এই টিভি নাটক দেখার? তাঁর হাতে রয়েছে সারা বিশ্বের রংচঙা হরেক রকমের চ্যানেল। সুতরাং, টিভি নাটক ছেড়ে তাঁরা চলে যাচ্ছেন অন্য কোথাও। বিজ্ঞাপনদাতারা বারবার একই বিজ্ঞাপন প্রচার করে ভাবছেন, বারবার দেখতে দেখতে হয়তো তাঁদের পণ্যটি ক্রেতাদের মনের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। অবস্থা কিন্তু তা নয়। একটি পণ্যের অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন দেখে অনেকের মনেই বিরূপ মনোভাব জন্ম নিচ্ছে। হয়তো বাজারে গেলে ওই অধিক বিজ্ঞাপিত পণ্যটি তিনি সযতনে এড়িয়ে যান।
ভালো মানের নাটক আর অল্প বিজ্ঞাপন দেখিয়ে দর্শকদের পুনরায় বাংলাদেশের টিভির প্রতি মন ফিরিয়ে আনুন। প্রমাণস্বরূপ, আমরা দেখছি, গত ঈদে কয়েকটি বেসরকারি টিভি স্বল্প বিজ্ঞাপন বা বিরতিহীন নাটক দেখিয়ে দর্শকদের ভীষণ রকম বিনোদিত করেছে। বাংলাদেশের টিভিতে বাংলাদেশকে দেখতে সবাই ভালোবাসেন, কিন্তু যখন সেই বিনোদনে ঘাটতি হয়, তখন তাঁরা ভারতীয় কিম্ভূতকিমাকার সিরিয়াল দেখে তাঁদের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান। আর বিজ্ঞাপনদাতারাও ঘোল খরিদ করার জন্য দেশের টাকা বিদেশে ঢালেন দেদার। ভারতীয় কোনো অনুষ্ঠান শুরু হলেই দেখতে পাই আমাদের দেশীয় কোনো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। বুকটা বড়ই ব্যথা করে তখন। এই বুকব্যথা আরও বাড়ে, যখন দেখি কলকাতার কোথাও কোনো জায়গায় আমাদের একটি চ্যানেলেরও প্রবেশাধিকার নেই। আর আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে তাদের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোকে যত্ন করে খাওয়াচ্ছি আমাদের সাধারণ জনগণকে। এই আমাদের দেশাত্মবোধ। ইদানীং অনেক ছেলেমেয়েকে হিন্দিতে কথা বলতে শুনি এবং বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বললে তারা মনে করে আমরা অশিক্ষিত। এভাবেই আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাকে ক্রমেই অজনপ্রিয় করে তুলছি।
সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে আমরা কমবেশি দেখেছি। ‘খনিতে যে করে শ্রম, যেন তারে ডরে যম’—এই টিভি ইন্ডাস্ট্রির নির্মাতা-লেখকেরা এখন হীরক রাজার খনির শ্রমিক সবাই। হীরকের রাজা, মানে এজেন্সি ও বিপণন দলের লোকজন এখন স্থির করে দিচ্ছেন কী হবে গল্প আর কে কে হবে তার কাস্টিং। এটি একটি বিপজ্জনক সত্য। একজন পরিচালক হয়তো ভাবলেন কোনো প্রধান চরিত্রের সঙ্গে একজন অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রী যথাযথ। কিন্তু তিনি যখন এই প্রস্তাব পেশ করলেন জনৈক প্রযোজকের কাছে, ব্যবসায়ী ভদ্রলোক বুঝুক না বুঝুক, তখন তিনি স্পষ্ট একটি সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবেন। যদি হীরক রাজার সিদ্ধান্ত অমান্য করা হয়, তাহলে তার শাস্তি মগজ ধোলাই। আমরা তখন মগজ ধোলাইয়ের ভয়ে নিঃশব্দে রাজার ইচ্ছা অনুযায়ী উৎপাদন করে যাই। এই স্বৈরাচারী মনোভাব বন্ধ করে শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলে আমাদের টিভি নাটকের মান বাড়বে বৈ কমবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
অনেক শূন্যতার কথা বলে ফেলেছি হয়তো। তবে টিভি পর্দায় ঈদ উপলক্ষে কিছু অসাধারণ গল্প দেখেছি। দেখে আনন্দিত হয়েছি, সুমন আনোয়ারের গুলবাহার, ওয়াহিদ আনামের নাটক চক্র, মানব পাচারের ওপর, এ ছাড়া মাহমুদ দিদারের রেইনবো (ইটস মাই লাইফ), গৌতম কৌরির প্রডাকশন। আরও অনেকেই আছেন, যাঁরা শত প্রতিবন্ধকতার ভেতরও বাংলাদেশি টিভি নাটককে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করে রেখেছেন। শুভেচ্ছা তাঁদের জন্য। শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা আমাদের দেশের দর্শকদের জন্য, যাঁরা শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এখনো বাংলাদেশের টিভিকে অনবরত দেখে যাচ্ছেন।
‘যে দেশের যুবসমাজ কাশির ওষুধ ফেনসিডিল খেয়ে নেশা করে, তাদের ভবিষ্যৎ কী? তাদের ভবিষ্যৎ বুড়ো বয়েসে খুক...খুক....করে কাশা।’ হুমায়ূন আহমেদের উক্তি দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা দিয়েই শেষ করছি। যে দেশের মানুষ (নতুনেরা) এলেবেলে টিভি নাটক দেখে বড় হচ্ছে, তারা ভবিষ্যতে হিন্দিতে কথা বলবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তা চাই না। আমরা জানি, আমরাই জয় করব। সব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ঠেলে সামনে এগিয়ে যাব।