ঝড় থেকে বাঁচলো সাতক্ষীরা বন্ধুসভা

ছোট ছোট ডিঙি নৌকাগুলো ঢেউয়ের তালে একটার ওপর আরেকটা আছড়ে পড়ছে। ছবি: সংগৃহীত
ছোট ছোট ডিঙি নৌকাগুলো ঢেউয়ের তালে একটার ওপর আরেকটা আছড়ে পড়ছে। ছবি: সংগৃহীত


ঘূর্ণিঝড় আম্পানকবলিত উপকূলের মানুষ যখন করোনা মহামারি ও আম্পান তাণ্ডবে দিশেহারা, তখন প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণসামগ্রী নিয়ে উপকূলের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরাতে ছুটে চলে সাতক্ষীরা বন্ধুসভার একদল সাহসী বন্ধু। গত ৩০ মে সকালে ত্রাণসামগ্রী প্যাকেট করে বন্ধুরা রওনা দেন সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে। গন্তব্য শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। বন্ধুরা ট্রাক নিয়ে নীলডুমুর পৌঁছায় সকাল সোয়া দশটায়। বাকি পথ যেতে হবে ট্রলারে।

৩০ মে সকালে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্ধুরা রওনা দেন। ছবি: সংগৃহীত
৩০ মে সকালে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্ধুরা রওনা দেন। ছবি: সংগৃহীত


খোলপেটুয়া নদীর ঘাটে পৌঁছামাত্রই বন্ধুরা ট্রাক থেকে ৪০০ ব্যাগ ত্রাণসামগ্রী কাঠের ট্রলারে ওঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দীর্ঘ এক ঘণ্টা খরস্রোতা নদীর ঢেউ ভেঙে দেখা মিলে আম্পান ঝড়ে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত চর গাবুরার।
চারদিকে শুধু অসহায় মানুষের হাহাকার, বন্ধুসভার বন্ধুদের দিকে মায়ার চোখে তাকিয়ে কী যেন বলতে চাইছিলেন তাঁরা। ৪০০ পরিবারের হাতে প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণসামগ্রী তুলে দিতে দিতে দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। মাঝি হাঁক দেয় ঈশান কোণে মেঘ জমেছে, আসতে পারে ভয়াল ঘূর্ণিঝড়। ফিরতে হবে নীলডুমুর, থাকতে থাকতে জোয়ার।

দক্ষ মাঝি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে পড়েন নদীতে। ছবি: সংগৃহীত
দক্ষ মাঝি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে পড়েন নদীতে। ছবি: সংগৃহীত


গাবুরার অসহায় মানুষগুলোর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে ৪টা ৪৫ মিনিটে আবার ট্রলারে যাত্রা শুরু। চারদিকে থই থই পানি। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমতে থাকে। তরী যখন মাঝ দরিয়ায়, শুরু হয়ে গেল ভয়াল ঘূর্ণিঝড়। এত বড় ট্রলার যেন সামান্য খড়কুটোর মতো ঢেউয়ের তালে তালে উতলা হয়ে উঠল। ভয়ে বন্ধুরা কজন ছুটল ট্রলারের গর্ভকক্ষে।

চারিদিকে শুধু অসহায় মানুষের হাহাকার, মায়ারচোখে কি যেন বলতে চাইছিল তাঁরা। ছবি: সংগৃহীত
চারিদিকে শুধু অসহায় মানুষের হাহাকার, মায়ারচোখে কি যেন বলতে চাইছিল তাঁরা। ছবি: সংগৃহীত


বাতাস আটকে ট্রলারের শামিয়ানা উড়ে যাওয়ার উপক্রম দেখে মাঝি বুদ্ধি করে শামিয়ানার বাঁধনগুলো নৌকায় থাকা কুড়াল দিয়ে কেটে দিলেন। তখনো বাতাসের ঘূর্ণিতে ট্রলার প্রায় উল্টে যায় যায় অবস্থা। ভয়ে সবার মুখ শুকিয়ে এসেছে। নদীর কিনারে থাকা ছোট ছোট ডিঙি নৌকাগুলো ঢেউয়ের তালে তালে একটার ওপর আরেকটা আছড়ে পড়ছে।

৪০০ পরিবারের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিতে দিতে দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। ছবি: সংগৃহীত
৪০০ পরিবারের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিতে দিতে দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। ছবি: সংগৃহীত


আমাদের নিয়ন্ত্রণহীন ট্রলারের ধাক্কায় একটা নৌকার মাথা গেল ভেঙে। মাঝি শক্ত হাতে ধরেছিলেন হাল, তখনই কিছু ভেঙে যাওয়ার শব্দে বিচলিত হয়ে ওঠেন সবাই। ভয়ে একে অপরকে শক্ত করে ধরে কাঁপতে কাঁপতে সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুতি জানাতে থাকেন এ যাত্রায় রক্ষা করার। ততক্ষণে প্রচণ্ড স্রোত ও উত্তাল ঢেউয়ে ট্রলারের দিক নির্ধারণকারী হালটি ভেঙে গেছে। ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঝড়ের টানে অজানায় ভেসে চলছে নিয়ন্ত্রণহীন ট্রলার।

তখন দক্ষ মাঝি তাঁর বিচক্ষণতা দেখিয়ে নোঙর ফেলে দেন দরিয়ায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দড়ি ধরে লাফিয়ে পড়েন নদীতে। একটানা প্রায় ১৫ মিনিট ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনোমতে সারিয়ে তোলেন নৌকার নিয়ন্ত্রণযন্ত্র, সেই হাল। ততক্ষণে আমাদের ট্রলার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অন্যদিকে চলে গেছে প্রায় ৩ কিলোমিটার। নোঙরের দড়ি বেয়ে তাঁকে ধরাধরি করে ট্রলার তোলা হয়। তারপর সবাই মিলে মাঝনদীতে ফেলা বিশালাকৃতির নোঙর টেনে তোলেন। 
মাঝি আবার শক্ত হাতে ট্রলারের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনেন ও ভয়ানক ঝড়ের কবল থেকে বন্ধুদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনেন নীলডুমুর ঘাটে। ট্রলার থেকে নেমে বন্ধুরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন আবেগে।

শেখ শরীফ হাসান: প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক, সাতক্ষীরা বন্ধুসভা