সাধারণ জীবন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি খুব সাধারণ মানুষ। গ্রামে বসত করি। তয় অসাধারণ হইবার খুব ইচ্ছা। স্টেজে গিয়া গানবাজনা করব, মানুষ হাততালি দিব। রাস্তাঘাটে আমারে দেখলেই খাতা আর সুন্দর দামি একটা কলম নিয়া দৌড়ানি দিব। আমি আমার সিগনিচার দিব।

গ্রামে এগুলা চলে না, সম্ভব না। মায়েরে যেদিন রাতে কইলাম যে শহরে যাব, গানবাজনা কইরা বড় মানুষ হব, পরদিন সকালেই ফজরের নামাজ পইড়া হুজুরের পানিপড়া আইনা আমারে খাওয়ায় দিল।

আমারে নাকি জিনে ধরছে, তাই উল্টাপাল্টা বকতাছি!

টিভির পর্দায় দেখায় শহরের ছোট বাচ্চারাও কী সুন্দর কইরা কথা কয়। যত ফাটা কপাল সব আমার। ফাটা কপাল দিয়া ব্রেইনের ঘিলুটাও বাইরিয়া গেছে, পড়ালেখা মাথায় ধরে না।

গ্রামের কলেজে অনার্স শেষ কইরা মাস্টার্স পড়ার জন্য পাড়ি জমাইলাম ঢাকার শহরে। সব আজগুবি মানুষ এইখানে।

আমার রুমমেট বড়লোকগো মতো সুন্দর ভাষায় কথা কয়। আমারও স্বাদ আছে। তাই তারে প্রতিদিন বহুত জ্বালায়া কিছু শিখছি আমিও।

আস্তে আস্তে আমিও আজব মানুষে বদলায় গেলাম। বন্ধুদের সঙ্গে এইখানে হ্যাংআউট করতে হয়, কোথাও যাওনের আগে পোশাক ম্যাচিং কইরা পরতে হয়। লুঙ্গি পইরা রাস্তায় বের হওন যায় না। ঠান্ডা যন্ত্রের ঠান্ডা রুমে বইসা চামুচ দিয়া বিদেশি খাওনের মধ্যে বড়লোকি আছে। ডাল আর আলুভর্তা চাইলে তারা ‘সরি’ বইলা চইলা যায়। ইংলিশ গানের লাইন না বুঝলেও বন্ধুগো লগে সুর মিলাইতে হয়, নয়তো তারা সঙ্গে নিয়া ঘোরে না।

আবার রুমে ফিরা সিজিপিএর লোভে রাত জাগা লাগে। অনেক ব্যস্ত আমি, সময় নাই এত যে গ্রামে ফিরা যামু।

পরের সপ্তায় কোন মুভি দেখতে যামু, সেইটা নিয়া আলোচনা করতাছি, এর মধ্যেই উটকো ঝামেলা হাজির। কাজকাম না থাকলে যা হয় আরকি! আম্মায় ফোন দিতাছে। ধরলেই আর ছাড়বো না। জিগাবো, বাপ খাইছো নাকি, কই আছো, এই-সেই কত-কী!

আরে, আমি শহরে আছি, পরিবেশ বুঝা লাগবো তো। বন্ধুগো সামনে মায়ের সঙ্গে কথা কওন যায় নাকি! এইটুকুও বোঝে না, সমানে ফোন দিতেই আছে।

‘এক্সকিউজ মি’ বইলা বের হইয়া আসলাম।

চারিপাশে এত মানুষ, কেউ আমার চিল্লানি শুনল না।

আম্মা...আম্মা...আম্মা বইলা চিল্লাইতে থাকলাম আমি।

রাস্তায় লুটাইয়া পড়লাম। কেউ তাকাইল না কেউ ধরল না।

এই শহরের অনেকেই আমারে চেনে এখন, আমি সুন্দর গান গাই তাই। কই, কেউ তো আগায়া আসলো না। এই শহর, এত পরিচিতি, এত অসাধারণ হইয়া কী হব। আমার মা যে আর নাই।
আমার মা। আম্মা, আম্মা।

আমি সাধারণ হইবার চাই আবার। সবাই অসাধারণ হইয়া বাঁচার পারে না রে মা।

আমারে সাধারণ বানায় দাও আল্লাহ,

আল্লাহ আমার মায়েরে ফিরায় দাও,

আমি গ্রামে ফিরা যামু।

কেউ আমার চিল্লানি শুনল না, আমার দিকে ফিরা তাকাইল না, একটু ধরলও না আমারে।

এই শহরটা অসাধারণ মানুষগোর।

আমি না পারলাম অসাধারণ হইয়া আমার মায়েরে ভুলতে, না পারলাম সাধারণ হইয়া মায়ের কোলে শুয়ে থাকতে।

মায়ের হাতের খাবার খাওনের মতো জীবনরে আমরা তুচ্ছ ভাবি। এই সাধারণ জীবন সারা জীবন পাওনের সৌভাগ্য সবার নাই।

আমি জলের মতো একা। জলে ভাইসা বেড়ান কচুরিপানার মতো, শিকড় নাই, স্রোতে ভাইসা বেড়াই।

শাতিল রহমান: সাধারণ সম্পাদক, টাঙ্গাইল বন্ধুসভা