কো-পাইলট

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হ্যালো!
এখনো ঘুমাচ্ছ?
হুম।
ফ্লাইট কয়টায় মনে আছে?
আছে।
উঠে পড়?
আরেকটু ঘুমাই।
সাতটা বাজে!
মাত্র!
দেরি হয়ে যাবে!
তুমি আছ না?

বলে আমি ফোন রেখে দিলাম। আজ আমাদের ফ্লাইট আছে। সুস্মিতা আবার ফোন করল। আমি বুঝতে পারছি সে–ও রানওয়েতে প্লেনের ঘোরাঘুরির মতো ঘুম থেকে উঠে বিছানায় গড়াগড়ি করছে। আমাকে ফোনে ডেকে তোলার চেষ্টা করছে। আমি তার ঘুম ঘুম কণ্ঠ শুনে বালিশে কনুই রেখে উপুড় হলাম। সুস্মিতা ঠিক টের পেল। বলল, উপুড়? আমি হাসলাম। আমার নিঃশব্দ হাসিও নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে তার কাছে।
আমি বললাম, তুমি?
আমি কী?
তুমি কি উপুড় না চিত?
কী বললে?
মানে তুমি কেমন করে আছ?
কেন বলব?
বলো না?
বলব না!

সুস্মিতার সঙ্গে কথোপকথন ইচ্ছা করেই দীর্ঘ করছি। আমার একটা একান্ত চ্যানেল আছে। সবারই থাকে বোধ হয়। আমি সেই চ্যানেলে সুস্মিতাকে দেখছি। কানে তার ঘুম ঘুম কণ্ঠ। আই জাস্ট লাভ ইট। সে এবার বলল, ‘আমি উঠছি।’
আমার চ্যানেলের বড় পর্দায় দেখতে পেলাম, সুস্মিতা তার অতল নরম বিছানা থেকে সাগরের ঊর্মিমালার মতো উঠে আসছে। রাতের পোশাকের গোলাপি বাহাদুরিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিখুঁত প্রস্তুতির দিকে যাচ্ছে।
এইটুকু দেখে আমি আমার চ্যানেলের সুইচ অফ করে বিছানা থেকে নেমে গেলাম। দ্রুত রেডি হতে হবে। ঘড়ির কাঁটার জীবন।

ককপিটে বসে আছি। বোর্ডিং চলছে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে উড়ব। আমার পাশে সুস্মিতা। কো-পাইলট। তাকে কী আজ একটু বেশি সুন্দর লাগছে! টমেটোর মতো গালে ব্লাশনের বেগুনি রেখা। যেন রংধনু উঠেছে গালে। তবে আমার চোখ এখন থাকবে আকাশে। মেঘমালার সঙ্গে হবে শুভ দৃষ্টি বিনিময়। সুস্মিতা বলেছে, সে মেঘমালাকে হিংসা করে। আমাকে ভালোবাসার পর আকাশের সঙ্গে তার আড়ি। আমি বলেছি, মনের চোখ আছে না? সে বলেছে, মনের চোখে তো দেখছি অহর্নিশি।

প্লেন স্টার্ট হলো। রানওয়ের বাতিগুলো সরে সরে যাচ্ছে দ্রুত। আরও দ্রুত। এ সময় সুস্মিতা নিশ্বাস বন্ধ করে রাখে। আমাকে বলেছে। আমি প্লেন টেক অফ করালাম।

নির্ধারিত উচ্চতায় ওঠার পর আমি সুস্মিতাকে একমুহূর্তের জন্য দেখলাম। তার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা দিয়ে আমি একবার একটা মালা বানাতে চাই।

আকাশে আজ অনেক মেঘ। আমরা এখন হাজার হাজার ফুট ওপরে। মেঘের কারণে মাঝেমধ্যে প্লেনের গতিপথ খুব সামান্য এদিক–সেদিক হচ্ছে। সুস্মিতাকে কিছুটা অস্থির দেখাচ্ছে। সে চায় মেঘহীন সুনীল আকাশ।

আমি সুস্মিতাকে দেখলাম। তার মুখে আকাশের মায়াভরা পূর্ণ আলো। আমার পরিমিত হাসি দেখে তার অস্থিরতা কর্পূরের মতো উড়ে গেল। কোনো কারণে অথবা অকারণে আমি তার হাতের স্পর্শ পেলাম আমার হাতে। সুস্মিতার পাখির বাসার মতো দুটি চোখে প্রেম ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই, এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে?

কেবিন ক্রু শারমিনকে দেখতে পেলাম। সে সুস্মিতাকে কিছু একটা বলছে। এমন সময় প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে সঙ্গে প্লেন বেশ কয়েকবার কেঁপে উঠল। আমি সতর্ক হয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছি। সুস্মিতাও। যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধার ঘোষণা দেওয়া হলো।

প্রপেলারের কোনো সমস্যা কী হয়েছে! কোনো পাখিই হয়তো আছড়ে পড়েছে এসে। সব চেক করলাম। কোন সমস্যা নেই। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ ঠিক আছে। নির্বিঘ্ন যাত্রার ঘোষণা দেওয়া হলো।

আকাশে এখন ঝকঝকে রোদ। তুলার মতো খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেসে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। সুস্মিতা বলেছে, সাদা মেঘের এই খণ্ডগুলো তার বালিশ। যখন খুব দুঃখ হয় তখন সে সেই মেঘের বালিশে মাথা রেখে শুয়ে থাকে। ভেসে চলে দূরাকাশে। আমি বললাম, ভুল কৌশল! সে বলল, মানে? আমি বললাম, আমি সারা দিন থাকি আকাশে। তুমি রাগ করে আর কোন আকাশে যাবে? শুনে সুস্মিতা হাসে। আমি দেখি সেই হাওয়াই মিঠাই হাসি।

সুস্মিতার সঙ্গে আমার পরিচয় একটা ডিনার পার্টিতে। আমার এক কলিগের পার্টি। চুপচাপ বসে আছি। এমন সময় পার্টির একদল মেয়ে এসে ঘিরে ধরল আমাকে। আপনি খুব সুন্দর গান করেন, তারেক ভাইয়ের গায়েহলুদে শুনেছি। একটা সেলফি তুলি? আমি হতভম্ব। কিছু বোঝার আগেই ডুবে গেলাম পারফিউমের মৌতাতে। আমি কোনো গায়ক নই, এই কথা বলার কোনো সুযোগই পাওয়া গেল না।

সেদিন রাতেই ফোনটা এল।
হ্যালো!
হ্যালো কে?
আমি!
আমি কে?
আমি!
আমি বিরক্ত হতে পারছি না। ফোন ধরে আছি। কারণ আমার কানে ততক্ষণে বর্ষিত হয়েছে এই পৃথিবীর মধুরতম কণ্ঠস্বর। সুস্মিতা এভাবেই একটা মধুমালতী হয়ে এসেছে। বসেছে আমার পাশে।
তারপর সে তার পরিচয় দেয়। বিয়েতে সেলফি তোলাদের একজন ছিল সে। আমার ফেসবুক আইডি নিয়ে ছবি পাঠাল। বলল, এই সেলফিটাতে চারটা মেয়ে আছে আপনার সঙ্গে, বলতে হবে আমি কোনটা? এভাবেই মিষ্টি প্রেমের সব রহস্যময়তা নিয়ে সুস্মিতা দ্রুত আমার হলো।

প্লেন উড়ে চলেছে। আমরা এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ভৌগোলিক সীমারেখায় ঢুকে পড়েছি। সুস্মিতার কথায় সংবিৎ ফিরে পেলাম। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করলাম। অনুকূল। সব সিগন্যাল ঠিক আছে।
উড়ে চলেছি গন্ত্যব্যের খুব কাছাকাছি। অবতরণের ঘোষণা দেওয়া হলো। সুস্মিতাকে নিয়ে আমি ল্যান্ডিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্লেন ধাপে ধাপে অনেক নিচে নামিয়ে এনেছি। এক্ষুনি ল্যান্ড করাব।
কিন্তু তা আর হলো না। আমার ঘুম ভেঙে গেল।

শাড়ির আঁচল কোমরে বেঁধে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুস্মিতা। তার এক হাত কোমরে, আরেক হাতে একটা বেলন ধরে আছে। নিশ্চয়ই রুটি বানাচ্ছিল।

আমাকে চোখ মেলতে দেখে বলল, তুমি কি আজ উঠবে না?

আমি আরেকটু ঘুমের আশা বাদ দিয়ে উঠে পড়লাম। আমার একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস পেছনে ফেলে সুস্মিতা ফিরে যাচ্ছে রান্নাঘরে। আমি কি এই সুস্মিতাকে চেয়েছিলাম!

ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে সামনের আয়নায় তাকিয়ে চমকে উঠলাম, আমার সেই চ্যানেল! এত বছর পর তার বড় পর্দা নিয়ে হাজির। এই সব চ্যানেল ফেনেল কবেই ভুলে গিয়েছিলাম।
প্রায় হারিয়ে যাওয়া চ্যানেলের পর্দায় ছায়াছবির মতো ভেসে উঠল সুস্মিতা রান্নাঘরে রুটি বেলতে বেলতে কপালের ঘাম মুছছে। সে কী ক্লান্ত প্রাণ এক!
শুনতে পেলাম সুস্মিতা বলছে, এই সংসারে এসে আমার জীবনটাই শেষ করলাম!