স্টেম সেল থেরাপি ও নভেল করোনাভাইরাস

লেখক
লেখক

নভেল করোনাভাইরাস (SARS-CoV-2) চীনের উহান প্রদেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশে আক্রমণ করেছে। এর প্রকোপে ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের প্রায় ৯ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৪ লাখ ৭৬ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর উহান সরকার বেশ কিছু নিউমোনিয়ার রোগী শনাক্ত করে, যার কারণ অজানা ছিল। কিছুদিন পরই এই নিউমোনিয়ার কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস পরিবারের এক বিশেষ সদস্য SARS-Cov-2–কে শনাক্ত করা হয়।

১১ জানুয়ারি ২০২০ উহানে এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত নিউমোনিয়ার রোগীর প্রথম মৃত্যু হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নভেল করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবকে ৩০ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে সারা বিশ্বের জন্য ‘পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি’ এবং ১১ মার্চ ‘মহামারি’ হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ৮ মার্চ নভেল করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। আজ অবধি ১ লাখ ২২ হাজার ৬৬০ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১ হাজার ৫৮২ জন মৃত্যুবরণ করেছেন।

নতুন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। বেশ কিছু দেশ ও প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১ ফেব্রুয়ারি নভেল করোনাভাইরাস দ্বারা মানবশরীরে সৃষ্ট রোগের নাম COVID-19 হিসেবে প্রস্তাব করে। আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে সাধারণত জ্বর, সর্দি, শুকনা কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, শরীর বা মাংসপেশিতে ব্যথা ইত্যাদি রোগ লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়। এখন পর্যন্ত শ্বাসতন্ত্রীয় নমুনার আরটি-পিসিআর (রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ-পলিমেরাস চেইন রিএ্যাকশন) পদ্ধতিটিই এই রোগ শনাক্তকরণের আদর্শ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ রোগীই মৃদু উপসর্গ প্রকাশ করে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সুস্থতা অর্জন করেন। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে ১৪ শতাংশ রোগী ‘সিভিয়ার ডিজিজ (Severe disease)’ এবং ৬ শতাংশ রোগী ‘ক্রিটিক্যালি ইল (Critically ill)’ হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করার প্রয়োজন হয়। আক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে এই ভাইরাস নির্মূলের জন্য এখনো পর্যন্ত স্বীকৃতি কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে ইতিপূর্বে অন্য রোগের জন্য আবিষ্কৃত কিছু ওষুধ (Repurpose use) (যেমন রেমডেসিভির, ফাভিপিরাপির, ক্লোরোকুইন/হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ইত্যাদি) ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। বেশ কিছু দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই এ ওষুধের কার্যকারিতা নির্ণয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ফলও আসছে।

করোনার সংক্রমণে সিভিয়ার ডিজিজের ক্ষেত্রে মৃত্যুর প্রধান কারণ ভাইরাস নিজে নয়; বরং ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতার অতিসংবেদনশীলতা। নভেল করোনাভাইরাস শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ফুসফুসের কোষে প্রবেশ করার পর ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির ফলে সংশ্লিষ্ট কোষটি পাইরোপটোসিস (Pyroptosis) দশায় পরিণত হয়, যা শক্তিশালী প্রদাহ সৃষ্টিকারী হিসেবে বিবেচিত। এর প্রভাবে ফুসফুসের এপিথেলিয়াল সেল, এন্ডোথেলিয়াল সেল এবং এলভিওলার ম্যাক্রোফেজ থেকে প্রদাহ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন প্রকার সাইটোকাইন ও কেমোকাইন (IL-6, IP-10, macrophage inflammatory protein 1-MIP1, MIP1 ও MCP1) নিঃসৃত হয়। এদের প্রভাবে উৎপত্তিস্থলের প্রতি প্রচুর পরিমাণে মনোসাইট, ম্যাক্রোসাইট ও টি-সেল আকৃষ্ট হয় এবং অধিকতর সাইটোকাইন ও কেমোকাইন (tumour necrosis factor-TNF, IL-6, and IL-1) নিঃসরণ ঘটে। এতে সাইটোকাইন স্টর্ম (Cytokine storm) হয়, যা ফুসফুসের অবকাঠামো ধ্বংস করাসহ অন্যান্য অঙ্গের (multi-organ damage) ক্ষতিসাধন করে।

সাধারণত সাইটোকাইন স্টর্ম নির্ণয়ে সিরাম ফেরিটিন লেভেল পরিমাপ করা হয়। এই সংকটকালীন দশাকে প্রশমন করার জন্য নির্দিষ্টভাবে অনুমোদিত কোনো ওষুধ নেই। প্রথাগত কর্টিকোস্টেরয়েড এই সাইটোকাইন স্টর্ম প্রশমিত করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, যদিও এর ব্যবহার ও কার্যকারিতা ক্ষেত্রবিশেষে বিতর্কিত। সম্প্রতি বিভিন্ন ইন্টারলিউকিন ব্লকার, যেমন anakinra (IL-1 ব্লকার), tocilizumab (IL-6 receptor ব্লকার) এবং Janus kinase (JAK) ইনহিবিটর নভেল করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট অতিসংবেদনশীলতা প্রশমনে গবেষণাধীন।

স্টেম সেল থেরাপি ইমিউন–সম্পর্কিত ডিসঅর্ডারে বিস্ময়কর সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষত আম্বিলিক্যাল কর্ড-ডিরাইভড মেসেনকাইমাল স্টেম সেল (বাচ্চা জন্মের পর গর্ভফুল থেকে প্রাপ্ত) COVID-19-এর সিভিয়ার নিউমোনিয়ায় সাইটোকাইন স্টর্ম প্রশমন ও নষ্ট হয়ে যাওয়া ফুসফুসের মেরামতে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মেসেনকাইমাল স্টেম সেল ও বিভিন্ন ইমিউন সেলের সেল-টু-সেল ইন্টারঅ্যাকশন এবং প্যারাক্রাইন ইফেক্ট দ্বারা ওভারঅ্যাকটিভ ইমিউন সিস্টেমকে সাপ্রেশন ও শক্তিশালী ইমিউনো-মডুলেশনের মাধ্যমে প্রশমন করতে পারে।

বেইজিং ইউঅ্যান হাসপাতালে সাতজন বিভিন্ন পর্যায়ের সিভিয়ার নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগী নেওয়া হয়, যাঁদের স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা চলাকালেও শারীরিক অবস্থা ক্রমাবনতির দিকে যাচ্ছিল। তাঁদের প্রত্যেককে শিরাপথে মেসেনকাইমাল স্টেম সেল দেওয়া হয়। তাঁরা দু-চার দিনের মধ্যেই কোনো প্রকার অপ্রীতিকর সাইড ইফেক্ট ব্যতিরেকেই করোনার উপসর্গমুক্ত হয়েছেন। বিং লিয়াং ও তাঁর দল বুশান পিপলস হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সী COVID-19 সিভিয়ার নিউমোনিয়াসহ ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্সে আক্রান্ত একজন ভদ্রমহিলাকে শিরাপথে আম্বিলিক্যাল কর্ড ডিরাইভড মেসেনকাইমাল স্টেম সেল দ্বারা চিকিৎসা করায় পরবর্তী দিন থেকেই তাঁর উপসর্গ কমতে থাকে এবং ইলেকট্রোলাইট প্যারামিটার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এ যাবৎকাল মেসেনকাইমাল স্টেম সেল দ্বারা COVID-19–জনিত সিভিয়ার নিউমোনিয়া চিকিৎসায় রেজিস্ট্রিকৃত চীন, ইরান, যুক্তরাস্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ৩০–এর অধিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলমান।

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত রিজেনারেটিভ মেডিসিন কোম্পানি মেসোব্লাস্ট (Mesoblast) একটি গবেষণায় নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ভেন্টিলেটর সাপোর্টেড রোগীদের শিরাপথে Remestemcel-L (মেসেনকাইমাল স্টেম সেল) দ্বারা চিকিৎসায় ৮৩ শতাংশ ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে স্বনামধন্য বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি Athersys এবং ইউনিভার্সিটি হসপিটাল ক্লিভল্যান্ড মেডিকেল সেন্টার যৌথভাবে COVID-19 সিভিয়ার ডিজিজে আক্রান্ত রোগীদের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ইতিমধ্যে শুরু করেছে। বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় স্টেম সেল থেরাপি অচিরেই উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে বিজ্ঞানীরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী।

ডা. মো. শহীদুল ইসলাম: পিএইচডি গবেষক, স্টেম সেল টেকনোলজি, তেহরান ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেস, ইরান। ভিজিটিং রিসার্চার, ইউনিভার্সিটি অব সান্টিয়াগো ডি কম্পোস্টেলা, স্পেন।