কপোতাক্ষ ডব্লিউ সিক্সটিন

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

ঠিক বেলা দুইটায় কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠলাম। আমি আর বাবা, উদ্দেশ্য চুয়াডাঙ্গা। চুয়াডাঙ্গা পৌঁছাতে আমাদের লাগবে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এই লম্বা সময়ে আমার যেন বিরক্তি না লাগে, তাই ২০ টাকা বেশি দিয়ে বাবা আমার জন্য জানালার পাশে সিট নিয়েছে। চ নম্বর বগির ডব্লিউ-১৬ নম্বর সিট। ট্রেনে উঠে মন খানিকটা খারাপ হয়ে গেল। আমার সিটে একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক জানালার বাইরে তাকিয়ে উদাস হয়ে বসে আছেন। উনার মুখে–হাতে অসংখ্য কাটা দাগ দেখে কিছুটা ভয়ও পেয়ে গেলাম।

‘আঙ্কেল, সিটটা আমার’, দেখলাম আমার কথায় তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। পরে বাবা বলল, তুই পাশের সিটেই আপাতত বস। অগত্যা বসতে হলো। তবে খুব রাগ হতে লাগল। এতটা সময়ের ভ্রমণে জানালার পাশে বসতে পারলে পুরো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যেতে পারতাম।

ট্রেন ঠিক ১৫ মিনিট বাদেই ছাড়ল। ঈদ বা পূজার মৌসুম না থাকার কারণে তেমন একটা ভিড় নেই। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ফেরিওয়ালা হরেক রকম দ্রব্য বিক্রি করে যাচ্ছে। কিন্তু খুব ভালো করে খেয়াল করলাম, আমার সিটে বসা ভদ্রলোকের কোনো দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বাবাকেও ইশারাতে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলাম, তবে খুব একটা সাড়া পেলাম না।

বিকেল পাঁচটার দিকে পোড়াদহ এসে ট্রেন ক্রসিংয়ের জন্য দাঁড়াল। হঠাৎ খেয়াল করলাম, পাশের ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসছেন। ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী একটা ছেলে ট্রেনের জানালার কাছে এসে খুব জোরে জোরে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগল এবং ব্যাগপত্র নামিয়ে নিতে শুরু করল। একটু পর চতুর্থ এই ব্যক্তি আমাদের বগিতে উঠে দুঃখ প্রকাশ করে মধ্যবয়সী লোকটির হাত ধরে ট্রেন থেকে নামবে, এ রকম মুহূর্তে বাবা আর আমি অবাক হয়ে এই অদ্ভুত দুঃখ প্রকাশের কারণ জানতে চাইলাম।

‘আসলে বছরখানেক আগে এক অ্যাক্সিডেন্টে আমার বাবার কান ও চোখ নষ্ট হয়ে যায়, কথাও বলেন না খুব একটা। সে জন্য রাজশাহী থেকে বড় ভাই জানালার পাশে বসিয়ে রেখে গেছে, যেন সহজেই আমি পোড়াদহ এসে বাবাকে খুঁজে নিতে পারি।’ কথাটা বলেই হড়হড় করে লোকটা নেমে গেল।

খুব খারাপ লাগতে শুরু করল। দেখলাম, বাবাও অনেকটা চুপ হয়ে গেছে। আমার আকাঙ্ক্ষিত ডব্লিউ–১৬ নম্বর আসনটা ফাঁকা রেখে আমি আগের জায়গাতেই বসে থাকলাম। মাঝেমধ্যে ওই জায়গার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছি, আর মাথায় হাজারো চিন্তা ভর করে মাথা ক্রমেই ভারী হয়ে চলছে। হঠাৎ বাবা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল, ‘এই সানি ওঠ, চুয়াডাঙ্গা চলে এসেছি...।’

বাবার হাত ধরে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। হঠাৎ প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনের জানালার দিকে তাকিয়েই মনে হতে লাগল, ওই মধ্যবয়সী বাবা আমাদের দেখছে আর আমাদের দিকে হাত নেড়ে জানাচ্ছে, ‘তোমাদের ধন্যবাদ’।

আল সানি: সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা