সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবনে গুজবের প্রভাব

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

বর্তমান সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবনে গুজব অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির কারণে মানুষ এখন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে খুব সহজেই গুজব ছড়াচ্ছে এবং নিজেও সেই গুজবের কারণে নানা রকম ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। যখন কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষ উদ্দেশ্যে কোনো প্রমাণহীন ও বিকৃত তথ্য অতিদ্রুত সমাজের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়, তখন তা গুজবে পরিণত হয়। মানুষ অতি সহজেই নানা ধরনের গুজবে নিজেকেও জড়িয়ে ফেলে। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এসব গুজবকে নিজের মধ্যে অনেক বেশি প্রশ্রয় দেয়। গুজব ছড়ানোর জন্য টেলিভিশন, সংবাদমাধ্যম, চিঠিপত্র, বেতার, টেলিফোন, মোবাইল ফোন অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, গ্রুপ ব্যবহার করে এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে। একটি সমাজে যখন নৈরাজ্য, হতাশা, বিশৃঙ্খলা, সামাজিক অবক্ষয়, আইনের অপব্যবহার বেড়ে যায়, তখন গুজবও বেড়ে যায়। বর্তমানে গুজবকে ব্যবহার করে নিজেদের প্রচারণাও করছে কেউ কেউ। বিভিন্ন রকম মিথ্যা তথ্য এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তি এভাবে পুরো সমাজ ও দেশের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে। তখন এসব মিথ্যা ও ভুল তথ্য কেউ যাচাই করার চেষ্টা করে না যে এটা আসলে কতটা সত্যি এবং কতটা মিথ্যা। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে গুজবকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। মনোবিজ্ঞানী জেমস ড্রিভার গুজব সম্বন্ধে বলেছেন, ‘Rumours is an unverified story calculating in a community, alleging the occurrence of a certain.’

গুজবের বৈশিষ্ট্য
গুজবের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো মিথ্যা ও ভুল তথ্যের বিকাশ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছড়িয়ে যাওয়া সংবাদের প্রকৃত ঘটনা বা তথ্য কারোরই জানা নেই। ছড়িয়ে পড়া এসব মিথ্যা তথ্যে ধীরে ধীরে আরও ভুল তথ্যের সংযোজন ঘটে এবং তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে বেশির ভাগ অবাস্তব ঘটনাকেই খুঁজে পাওয়া যায়। আর এসব জনমনে ও সমাজে বিস্তার ঘটে অতি দ্রুততার সঙ্গে। আবার অনেক সময় বাস্তব ঘটনাকে বিকৃত করার মাধ্যমেও ছড়িয়ে দেওয়া হয় সমাজে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছড়িয়ে পড়া ঘটনার সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার ব্যাপক অসামঞ্জস্যতা রয়েছে।

প্রকৃত অর্থে, যখন বিভিন্ন ধরনের গুজব আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, তার প্রকৃত উৎস কারোরই খুব একটা জানা থাকে না। মানুষ তথ্যের যাচাই না করার কারণে তা আরও বেশি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে সমাজজীবনে।

সমাজে গুজব কত দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়বে, কাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে, তা কিছু বিষয়ের ওপরে নির্ভর করে। গুজবের বিষয়বস্তু, ধরন, কৌশল, সময়, প্রয়োজনীয়তা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

তথ্যের বিকৃতি ও অতিরঞ্জনের কারণে গুজব জনজীবনকে নানান রকমভাবে বিপর্যস্ত করে তুলে। গুজব খুব সহজেই মানুষের ওপরে প্রভাব বিস্তার লাভ করে, তাই অনেকে বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্যকে কেন্দ্র করে সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায় মূল ঘটনার সঙ্গে গুজবের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।


গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণ
কিছু কুচক্রী ব্যক্তি সমাজের মধ্যে কৌশলে গুজব ছড়িয়ে দেয়। এসব গুজব যখন সমাজে ছড়ায় তখন সমাজে বসবাসরত মানুষ শুধু ওই সব বিষয়ের ওপর নজর দেয়, ফলে কুচক্রী মহল তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারে। এ ছাড়া কেউকে ছোট করা বা বিপদে ফেলার জন্য এসব কৌশল অবলম্বন করা হয়।

যে ব্যক্তি গুজব ছড়িয়েছে, সে হয়তো বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনেক মানসিক চাপ ও অস্বস্তির মধ্যে থাকে, তাই তা থেকে মুক্তি লাভের আশায় গুজব ছড়িয়ে থাকে।

আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবন পরিচালনায় অনেক সময় নানা ধরনের নতুন ও কঠিন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সহজে সব বিষয় বুঝতে পারি না। নানা ধরনের ভুল উপস্থাপন, তথ্য ও প্রচারের কারণে অতিদ্রুত জনজীবনে গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

যখন কোনো ব্যক্তি কোনো তথ্য ও সংবাদ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানতে পারে, তখন অন্য আরেকজনকে জানানোর আগে ঘটনার সত্যতা যাচাই করা অনেক বেশি প্রয়োজন। কিন্তু কিছু মানুষ যাচাই না করেই অতিদ্রুত আরেকজনকে জানিয়ে দিচ্ছে, যার কারণে প্রকৃত সত্য আর কখনোই বের হচ্ছে না।

বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি এবং দ্রুত গুজব ছড়ানোর পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশি প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এসব ব্যবহার করার সঠিক নিয়ম ও কৌশল অনেকেই জানে না। তাই তারা অতি সহজেই এসব গুজবের কথা নিজে বিশ্বাস করছে এবং অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গুজবকে প্রতিহত করার কৌশল
কোনো একটি ঘটনা বা তথ্য জানার পর তা প্রথমে যাচাই করে দেখতে হবে তা কতটা সত্য বা মিথ্যা। যদি ঘটনা মিথ্যা হয়, তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং সত্য সবার কাছে তুলে ধরতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্রপত্রিকার মাধ্যমে গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি বিষয়টি মানবকল্যাণের জন্য ক্ষতিকর হয়, তার জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গুজব থেকে মুক্তির জন্য জ্ঞানী এবং দক্ষ মানুষের কাছ থেকে সঠিক তথ্য ও ধারণা নিয়ে ভুল বিষয়বস্তু থেকে মুক্তি লাভ করতে হবে।

যেসব কঠিন ও জটিল বিষয় নিয়ে জনমনে নানা ধরনের প্রশ্ন এবং উদ্বেগ রয়েছে সেসব সঠিক তথ্য সবার সামনে সহজভাবে উপস্থাপন করা।

আমাদের জাতীয় জীবনের সংকটকাল যেমন যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে মানসিকভাবে শক্তিশালী থাকতে হবে। সহজেই কোনো বিষয় নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না এবং অন্যকেও ভয়ভীতি দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

গুজবের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ যদি সমাজের মানুষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে শাস্তি প্রদান করা।

বাংলাদেশের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নানা ধরনের গুজবের খবর প্রায়ই শোনা যায়। বিশেষ করে বর্তমানে গুজবকে কেন্দ্র করে নিরাপরাধ মানুষকে গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যা করা, বিভিন্ন সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণে মানুষের মাথা লাগে—এ রকম কুসংস্কার ছড়িয়ে সমাজের মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্তমানে করোনার সময়েও নানান ধরনের গুজব, যেমন এলাকায় চোর-ডাকাত ঢুকেছে, জীবিত মানুষকে মৃত বলে প্রচার করা—এ রকম গুজবের কথা শোনা যাচ্ছে। বর্তমানে যেই পরিস্থিতি চলছে সেখানে গুজবের ভয়াবহতা ব্যাপক। তাই সবার উচিত গুজব থেকে বিরত থাকা এবং অন্যকেও বিরত রাখা।

শামীমা আক্তার রোজী: প্রভাষক, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, তেজগাঁও, ঢাকা

 বন্ধুসভায় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]