একটি অভিমানী প্রাণ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সন্ধ্যা হতে এখনো বেশ খানিকটা সময় বাকি। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত গোল থালার মতো সূর্য পশ্চিম আকাশজুড়ে লালিমা ছড়ালেও এখন তার ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট নেই। বরং তার জায়গা দখল করেছে একরাশ কালো মেঘ। পড়ন্ত বিকেলে নদীর পাড়ে হিমেল হাওয়ায় বসে আকাশের আচমকা পরিবর্তন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে রিনি। অন্য সময় হলে সে হয়তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত, কিন্তু আজ তার চোখে–মুখে খেলা করছে অদ্ভুত এক বিষণ্নতা। নিজের জীবনের হিসাব মেলাতে মেলাতে নরম ঘাসে আলতো আঙুল ছোঁয়ায় রিনি। যেন আঙুল দিয়েই এক জীবনের সব না পাওয়া সে ছড়িয়ে দেবে সবুজ প্রকৃতির গায়ে।

রিনিকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে নিজের জীবনের সব আলো নিভে গিয়েছিল রিনির মায়ের। এমনকি নিজ গর্ভে যত্নে লালন করা সন্তানকে চোখের দেখাও দেখে যেতে পারেননি। অবশ্য মা হারানোর ব্যথা কখনো তাড়া করতে পারেনি রিনিকে। বাবা আর মেয়ে মিলে সাজিয়েছিল ছোট্ট এক পৃথিবী। যেখানে কখনো কারও অনুপ্রবেশ ঘটতে দেননি রিনির বাবা রাশেদুর রহমান। কিন্তু পরিবর্তনটা এসেছিল রিনির হাত ধরেই। মাধ্যমিক টপকানোর পরই রিনির আবদ্ধ পৃথিবীতে যুক্ত হয়েছিল প্রবাল নামক বিশাল এক আকাশ। প্রথমে নিজেকে গুটিয়ে রাখলেও একসময় সেই আকাশে ইচ্ছেমতো উড়ে বেড়াতে লাগল রিনি। প্রবালের হাত ধরে রিনির রংহীন জীবনে এসেছিল রঙের ছোঁয়া। সময়গুলো কাটছিল একদম স্বপ্নের মতো সুন্দর।

কিন্তু একদিন ছন্দপতন হলো সবকিছুর। রিনির সুখের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালেন স্বয়ং রিনির বাবা! মেয়ের উড়ু উড়ু ভাব হয়তো চোখে পড়েছিল তাঁর। তাই তো আগের থেকে একটু বেশি সচেতন হলেন তিনি। এটা করবি না, ওটা করবি না, সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে থাকা একদম নিষেধ, বাইরে গেলে বোরকা পরে যাবি—এমন হাজারটা বিধিনিষেধ জুড়ে দিলেন রিনির সঙ্গে। বাবার প্রতি বিরক্তিটা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল রিনির। তা ছাড়া নিজেদের আর্থিক অসচ্ছলতা মানসিক পীড়া দিত রিনিকে। যেখানে প্রবালের বাবা একজন উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা, সেখানে তার বাবা একটা নামেমাত্র স্কুলের শিক্ষক! বাবার কিনে দেওয়া সস্তা জিনিসগুলোতে আগে ভালোবাসা খুঁজে পেলেও এখন লজ্জা লাগে রিনির। প্রবালের সামনে ওসব পরে যাওয়া যায় নাকি! তা–ও সবটা মেনে নিচ্ছিল মুখ বুজে। কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল সেদিন, যেদিন বাবা দরজার বাইরে থেকে রিনির ফোনালাপ শুনে নিয়েছিলেন।

প্রবালকে সময় দিতে না পারায় সম্পর্কটা খারাপ হচ্ছিল দিন দিন। সমস্যা যেহেতু রিনির দিক থেকে ছিল, তাই ভালোবাসার পরীক্ষা দেওয়ার দায়ভারও বর্তাল রিনির ওপর। অন্ধমোহে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রিনি যখন প্রবালের পছন্দমতো সাজে নিজেকে সাজাচ্ছিল, তখনই আচমকা ঘরে এসেছিলেন বাবা। প্রথমবারের মতো মমতামাখা হাত শক্ত হয়ে উঠে এসেছিল রিনির গালে। সেই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন রিনির ফোনটাও। কিন্তু রিনিই বা কম কিসে? টানা তিন বেলা না খেয়ে তবেই ফোন ফেরত পেয়েছে সে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। সুযোগসন্ধানী প্রবাল ফিরে আসেনি আর, বরং রিনির নিখাদ ভালোবাসায় লাগিয়ে দিয়েছিল মিথ্যা দোষের প্রলেপ।

প্রবালবিহীন জীবন ভাবতেই পারে না রিনি। তাই তো নিজেকে বিসর্জন দিতে চলে এসেছে প্রিয় নদীর পাড়ে, যেখানের প্রতিটা কোনায় মিশে আছে তাদের ভালোবাসাময় স্মৃতি। সব থেকে কাছের মানুষটাকে হারালে কেমন লাগে, বাবা বুঝবে এবার। এসব ভাবতে ভাবতে যখন পানির দিকে এগোচ্ছিল রিনি, তখনই গুমোট অন্ধকারের ভেতর থেকে দুজোড়া পুরুষালি হাত টেনে ধরল তাকে। টেনে নিয়ে গেল ঝোপের আড়ালে। ঠিক তখনি ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি। নিষ্ঠুর মেঘের একটানা আওয়াজে হারিয়ে যেতে লাগল এক ভীত হরিণীর বুকফাটা আর্তনাদ। বৃষ্টির পানি, চোখের জল আর লাল রঙের তরল মিলেমিশে হয়ে গেল একাকার।

ঘণ্টাখানেক পর অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল দুটি মানুষরূপী হায়েনা। দ্রুত পা চালিয়ে প্রস্থান করল জায়গাটা থেকে। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছে একযোগে। নিঃস্তব্ধতার পর্দা ভেদ করে সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। অদূরে দাঁড়ানো কদমগাছটার দিকে তাকিয়ে আছে মৃতপ্রায় এক তরুণী। কিছুক্ষণ আগেও যে চোখে অভিমান, অভিযোগ আর মুগ্ধতার অদ্ভুত মিশেল ছিল, এখন সেই চোখে শুধুই শূন্যতা। মুখে কথা বলার শক্তি না থাকলেও তার মন চিৎকার করে বলছে কিছু করুণ আকুলতা, ‘আমি মরে যাচ্ছি বাবা। তোমাকে শাস্তি দেওয়ার বদলে তোমার রিনিঝিনি আজ জীবনের সব থেকে বড় শাস্তিটা পেল। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। আমাকে বাঁচাও বাবা। আমি আরেকবার তোমার মুখ থেকে রিনিঝিনি ডাকটা শুনতে চাই। আর কখনো তোমার অবাধ্য হব না বাবা। আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে...বাবাআআ...।’

একই সময়ে শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় নিজের আদরের মেয়েকে পাগলের মতো খুঁজতে থাকা এক অসহায় বাবার বুকটা কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্রমাগত মেয়ের নিরাপত্তা চাইতে থাকা মানুষটা ঘুণাক্ষরে জানতে পারল না অল্প কিছুক্ষণ আগেই দুনিয়া ত্যাগ করেছে একটি অভিমানী প্রাণ, যে নিজের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত খুঁজে বেড়িয়েছে বাবার কোলের উষ্ণতা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বন্ধুসভায় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]