'ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে'

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

‘হয়েছো তুমি রাতের শিশির—
শিশির ঝরার স্বর
সারাটি রাত পদ্মপাতার পর;
তবুও, পদ্মপত্রে এ-জল আটকে রাখা দায়।’

‘তোমাকে ভালোবেসে’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ এই চার লাইনে মানবজীবনের এক জটিল অঙ্কের খানিকটা দৃশ্যমান করেছেন। এ কবিতার শেষ লাইনেও পদ্মপাতায় পানি আটকে রাখার যাতনার কথা তিনি বলেছেন। পদ্মপাতায় পানি আটকে রাখা যাক বা না যাক, করোনাকালীন এই দুর্যোগে আমাদের কিন্তু ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মত বিশ্লেষণ করলে যতটুকু জানতে পারি, সামাজিক দূরত্বই একমাত্র এই প্রকোপকে ধীরে ধীরে নিম্নমুখী করতে পারে। আর তা নিশ্চিত করতে না পারলে এই দুর্যোগ এখনকার থেকেও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে, যা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে আরও বেশি ব্যাহত করবে। নিম্নবিত্ত মানুষকে আরও বেশি ভোগাবে। সেই সামাজিক দূরত্বই আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।

দেশে দিনমজুরের সংখ্যা প্রায় এক–চতুর্থাংশ। আর শ্রমিক তো প্রায় অর্ধেকের বেশি। এত বেশি শ্রমিক বা দিনমজুর, যাঁদের কিনা সঞ্চিত কোনো সম্পদ বা অর্থ নেই, সেখানে সম্পূর্ণ লকডাউন দেওয়া শুধু অযৌক্তিকই নয়; বরং হৃদয়হীনতার পরিচয়। পাশাপাশি সামাজিক বেশির ভাগ কাজেই এখনো আমরা প্রযুক্তিনির্ভর হতে পারিনি। ডেলিভারি বা অনলাইন লেনদেনের মতো বিষয়গুলোতে অভ্যস্ত হতে পারিনি। এখনো আমাদের বাজারসদাই করতে ঘরের বাইরে যেতে হয়, টাকার লেনদেন করতেই হয়। ব্যাংকে যেতে হয়। এগুলো অনস্বীকার্য, করতেই হবে।

প্রকৃতপক্ষে সমস্যা হচ্ছে, যখন আমাদের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ অপ্রয়োজনে বা খেয়ালি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে আসা কমাতে বা বন্ধ করতে পারে না। সংবাদমাধ্যমগুলোতে এ রকম খবরের ছড়াছড়ি। এই সংখ্যা দিন দিন কেবলই বেড়ে চলেছে। কৃত্রিম প্রয়োজনের নামে চায়ের দোকানে আড্ডা, দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি অপ্রয়োজন বা স্বল্প প্রয়োজনকে নিয়মিত করে ফেলা হচ্ছে। অবচেতনভাবেই অন্যদেরও অপ্রয়োজনে বাইরে আসতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

বৃহৎ ক্ষেত্রে নাগরিকদের অধিকার আদায় ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। যদি স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করি, তাহলে রাষ্ট্রের করণীয় অনেক। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নির্বাহী ব্যবস্থার সঙ্গে আইন ও বিচারব্যবস্থাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। করোনার সংক্রমণের এই সময়ে ত্রাণের মতো কিছু ব্যবস্থা দিয়ে নির্বাহী অংশের কিছু নতুন পদক্ষেপ দেখলেও আমরা আইনব্যবস্থার নতুন কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ লক্ষ করিনি। যদিও ভার্চ্যুয়াল আদালত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিচার অংশের অন্যতম ও অভানীয় মাত্রা যোগ করেছে। তবে নতুন আইন তৈরি ও প্রয়োগ করে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সুশৃঙ্খল জীবন নিশ্চিত করতে এখনো কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। নতুন আইনের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ ও দীর্ঘ কার্যপ্রণালীর অন্তর্গত। তাই সে কথা বাদ দিলেও বিদ্যমান আইনগুলো যথাযথ পালনে মনোযোগী ও যত্নবান হলে খানিকটা সুফল আমরা পেলেও পেতে পারি। কারণ, তিনটি অংশের সমান ও সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের কাঠামো আরও গতিশীল ও মজবুত করা সম্ভব।

মাত্র বছর দুয়েক আগে জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে বিধান প্রণয়নকল্পে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়; যা ২০১৮ সালের ৬১ নম্বর আইন। ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’ নামক আইনটিতে চলাফেরা বা প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, কোনো এলাকা বা ব্যক্তিকে সাময়িক বিচ্ছিন্নকরণ, কোনো যানবাহন বা স্থাপনা জব্দ করাসহ প্রয়োজনে স্থাপনা ধ্বংস করার ক্ষমতা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারী, তথা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমোদিত ব্যক্তিকে অর্পণ করা হয়েছে। উক্ত আইনের ধারা ১১ থেকে ধারা ২৬ পর্যন্ত আমদানি–রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ উপরোক্ত সব আইনের সুস্পষ্ট বর্ণনা করা আছে। তবে বোঝার সুবিধার্থে কয়েকটি আইন হুবহু তুলে ধরলাম।

সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮-এর ১৬ ধারার ১ উপধারার (গ)–তে পরিষ্কার বলা হচ্ছে, ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারী সন্দেহজনক স্থান, স্থাপনা বা প্রাঙ্গণ জীবাণুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত স্থানে জনসাধারণের প্রবেশ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিতকরণ করতে পারবেন। একই আইনের ২৫ ধারার ১ উপধারার (খ)–তে বলা হচ্ছে, যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। আবার ২৫ ধারা উপধারা ২-এ বলা হচ্ছে, যদি কোনো ব্যক্তি ২৫ ধারা উপধারা (১)–এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। মাত্র দুই বছর আগে প্রণীত এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ এই করোনার দুর্যোগ মোকাবিলায় আইনগত দিক থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের বাকি অংশগুলোর জন্যও ব্যাপক সহায়ক হবে।

যদি আরেকটু ভিন্ন দিক দিয়ে এ ব্যাপারকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে বলতে হয়, দণ্ডবিধি, ১৮৬০ আইনটির কথা। দণ্ডবিধি, ১৮৬০ আইন বাংলাদেশে ফৌজদারি অপরাধসংক্রান্ত দণ্ড দেওয়ার জন্য প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ আইন। সেই আইনের ২৬৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে বা অবহেলামূলকভাবে এমন কোনো কাজ করে, যা জীবন বিপন্নকারী মারাত্মক কোনো রোগের সংক্রমণ করতে পারে, তা জানা সত্ত্বেও বা বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও তা করে, তবে সেই ব্যক্তি ছয় মাস পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে। উপরন্তু দণ্ডবিধি, ১৮৬০ আইনের অপর একটি ধারা ২৭১-এ পরিষ্কার বলা হচ্ছে, ‘যেসব স্থানে সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ দেখা দিয়েছে, সেসব স্থানের সাথে অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ সম্পর্কে, সরকার প্রণীত বা জারিকৃত কোয়ারেন্টিন বিধি বা নিয়ম, কোনো ব্যক্তি যদি জ্ঞাতসারে অমান্য করে, তবে সে ব্যক্তি ছয় মাস পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’ এসব আইনের আলোচিত ধারাগুলো অনুসারে চাইলেই নাগরিকদের অপ্রয়োজনে বাইরে চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে, বৃহৎ স্বার্থে তাদের শৃঙ্খলিত ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাখা সম্ভব।

একজন নাগরিকের আইনের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাস তখনই জোরালো হয়, যখন সে দেখে প্রতিকূল সময়গুলোতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। তাই সাধারণ নাগরিকদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারানোর অন্যতম বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় প্রয়োগ বা বাস্তবায়নে যদি আইনের দুর্বলতা থেকে যায়। যেখানে বিশ্বের বেশ কিছু দেশ নতুন লকডাউন ল তৈরি করেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কড়াকড়ি করতে ঘাম ঝরাচ্ছে আর লকডাউন ভেঙে রাস্তায় বের হলে তো গুলি করার ঘোষণা দিয়েছে খোদ ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতি।

নতুন আইনের কথা বাদ দিলেও বিদ্যমান আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন করে আমরা অপ্রয়োজনে নাগরিকদের বাইরে বের হওয়া সহজেই বন্ধ করতে পারি। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সম্পূর্ণ লকডাউন দেওয়া যেহেতু সম্ভব নয়, তাই বর্ণিত আইনগুলোর মাধ্যমে আমরা অযথা, অপ্রয়োজনে বাইরে আসা জনগোষ্ঠীকে ঘরে রেখে কিছুটা হলেও সংক্রমণের মাত্রা কমাতে পারি। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তাঁদের বিবেক, বিবেচনার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সে প্রতিফলন আমাদের দেখাবেন, সেটাই প্রত্যাশা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত দুটি লাইন দিয়ে শেষ করছি, যা তিনি লিখেছিলেন এক আষাঢ় মাসের অন্য এক পরিপ্রেক্ষিতে। কাকতালীয় হলেও সত্য শতবর্ষ পরে, আজ এক আষাঢ় দিনেও ভিন্ন অর্থে কবির দ্বিতীয় লাইনটি অসম্ভব সামঞ্জস্যপূর্ণ:

‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।’

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

বন্ধুসভায় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]