সেদিন বর্ষাকাল

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

টানা বৃষ্টিতে উঠোনের মাটি মাখো মাখো হয়ে আছে। পা পড়লেই ছোট মতো গর্ত হয়ে যায়। পাশের জল এসে সেই গর্ত আবার ভরিয়ে দেয় এক নিমেষে। বিকেল থেকেই আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। সূর্য লুকিয়েছে। কেমন যেন রাত রাত মনে হচ্ছে। সেই ক্ষীণ আলোতে উঠোনে আমি পদচিহ্ন আঁকছি। ‘পানি পাড়াস নে। ঠান্ডা লেগে যাবে’। মায়ের হাঁকে শেষ করে দিই খেলা।

দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। বিদ্যালয় বন্ধ। সেটা না হলেও সমস্যা ছিল না। এমন বর্ষার সন্ধ্যায় বৃষ্টি মানেই ছুটি। কবিগুরু শিখিয়েছেন, ‘মেঘের কোলে রোদ’ এসে ‘বাদল গেছে টুটি’ দেখলেই ছুটি। আমার জন্য যেকোনো সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলেই ছুটি। আমরা বসে আছি রসুইঘরে। মা, চার বছরের ছোট বোন আর আমি। বোন আর আমি মিলে এখন নতুন একটা খেলা খেলছি। ‘কাগজ কাগজ খেলা’। ছোট ছোট কাগজ কেটে আমি পেনসিলে ছবি আঁকছি। মুখের ছবি, ফুলের ছবি, নদীর ছবি। সেই কাগজটা পানিতে ভিজিয়ে সেঁটে দিতে হবে হারিকেনের চিমনিতে। একটু পরে নাকে আসবে পোড়া পোড়া গন্ধ। কাগজ শুকিয়ে তখন মচমচ করবে।

মা বসেছেন চিংড়িগুলো নিয়ে। দুপুরে বাবা বের হয়েছিলেন ডিঙি নৌকা করে বিলে। জালে ধরা পড়েছে অনেক টেংরা, বেলে, পুঁটি আর গুঁড়া চিংড়ি। দুপুরে আলু আর বেগুন পাতলা করে কেটে মা করেছিলেন চিংড়ি বাদে বাকি মাছগুলোর ঝোল। ওপরে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন সবুজ সবুজ ধনেপাতা। সেই গন্ধে আমরা বাসন নিয়ে ছুটে এসেছিলাম রসুইঘরে। ‘তোদের বাজান গোসলটা করে আইলেই ভাত দিমু। পুরান চাল সেদ্ধ হইতে দেরি হবে’। হেসে বলেছিলেন মা। খেতে বসে এদিক–ওদিক তাকিয়ে খুঁজছিলাম, চিংড়ি গেল কই?

কুপির সলতেটা মা একটু নেড়ে দিলেন। জেগে ওঠা আলোতে দেখলাম পাটায় মা চিংড়ি বাটছে। সঙ্গে লাল লঙ্কা, রসুন। চিংড়ি ভর্তা হবে। খুশিতে মন লাফিয়ে উঠছে। কিন্তু ভর্তা তো মা করে দুপুরবেলায়। সঙ্গে আর কিছু থাকবে? ‘ব্যাঙ, ভাইজান’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে বোন। তিনটা ব্যাঙ ঢুকে পড়েছে বেড়ার নিচ দিয়ে। ওদের চিনি আমি। রোজই আসে। টুকটুক করে লাফ দেয়। আমরা ধরতে গেলে পালিয়ে যেতে চায়। এক–দুদিন ভয়ে পেশাব করে দেয়। বড্ড নিরীহ বেচারা এই ব্যাঙগুলো।

পাটায় এখন ভিজিয়ে রাখা চাল আর ডাল। পাশে একটা বাসনে কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, পেঁয়াজ। আমার যেন চাঁদরাতের আনন্দ পেয়ে বসে। চাপটি হবে, আজ চাপটি বানানো হবে। এগুলো একসঙ্গে মেখে তাওয়ায় দিয়ে ঢেকে দিবেন মা। একটু পর রুটির মত হলুদ মচমচে চাপটি। চিংড়ি ভরতা দিয়ে মজা করে খাব। আমার চোখের ভাষা পড়ে ফেলেছেন মা। ‘তুই তো চাপটি খাবি না, তাই না?’ আমি ছুটে আসি, ‘ইশ্, আমি দশটা চাপটি খামু। আর কত দেরি হইব মা?’ ‘এই হইল বইলা। ছাতা আর হারিকেনটা লইয়া তোর জেঠাদের বাড়িতে যা তো বাপ। তোর বাজান গেছে রেডিও শুনতে। স্বাধীন বাংলা বেতার। গিয়া ক, মায় খাইতে ডাকছে।’

সেদিন বর্ষাকালের সন্ধ্যারাত। পানি-ভরতি উঠোনে পা ফেলছি মেপে মেপে। একটু এদিক–সেদিক হলেই আলুর দম। রসুইঘর আর গোয়ালঘরের মাঝখান দিয়ে ছোট একটা সরু রাস্তা। সেটা পার হলে জেঠাদের পালান। পালানের পানিতে আমার গোড়ালি ডুবে ডুবে যাচ্ছে। হঠাৎ আসা বাতাসে আমার ছাতা হাত থেকে যেন পড়ে যেতে চাচ্ছে। এই তো জেঠাদের জোড়া কাঁঠালগাছ। বাহির বাড়িতে আজ কেউ নেই? বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গিয়ে রেডিওতে শব্দ ভেসে আসে। একটি বজ্রকণ্ঠ। ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়’। এই কণ্ঠস্বর আমার চেনা। এই ভাষণ আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।

সবাই ছিল একটা ঘোরের মধ্যে, তাই বুঝি আমাকে খেয়াল করেনি। বাবাই প্রথমে দেখেন। ‘আরে বাজান, এই বাদলার মধ্যে কেমনে আইলা? হায়, হায়, ভিজে কাক হয়ে গেছে দেখি। ঠান্ডা লাইগা যাবে। আসো, বাড়িতে যাই। আমি আইজ যাই ভাইজান।’ আমাকে কোলে করে দশ মিনিটে আসা পথটা বাবা দুই মিনিটে পার হয়ে এসে পড়লেন।

গরম গরম চাপটি আর ভর্তা বাসনে বাসনে। ছোট বোনটাও খাচ্ছে মজা করে। চোখে আমাদের খুশির ঝিলিক। ‘মিলিটারি ঢুইকা পড়ছে মোস্তফাপুরে। বাড়িঘর পুড়ায়া দিতাছে। গুলি কইরা সব শেষ করে দিতাচ্ছে। আর জোয়ান...’, বাবার কণ্ঠ থেমে আসে। হয়তো খাদ্যনালিও চেপে আসে। বাবা মুখে দিতে পারেননি একটা টুকরোও। ‘রমিজ, হাসু, সিদ্দিক—ওরা মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাইছে। এইভাবে ভীরুর মতো বাঁচা যায় না। বঙ্গবন্ধু ঠিক কথা কইছে। আমাগোর যা কিছু আছে, তাই নিয়াই মোকাবেলা করতে হইব।

‘তুমি গেলে আমাদের কী হইব? আমরা যামু কই?’ মায়ের চোখে জল টলমল করছে। আমারও কেন যেন ভয় লাগছে।

‘আল্লায় দেখব তোমাদের। দেশ স্বাধীন না কইরা আমি ফিরব না।’

সেদিন বর্ষাকাল। বেড়ার চালে বৃষ্টি পড়ছে ঝপঝপ করে। একটা হারিকেন আর একটা কুপি জ্বলছে আমাদের রসুইঘরে। জলের ছিটা পড়ছে আমাদের গায়ে। তিনটা ব্যাঙ লাফাচ্ছে। কালো বিড়ালটাও খাবারের লোভে ঘাপটি মেরে আছে। ছোট বোনটা ঘুমিয়ে গেছে। আমাদের তিনজনের সামনে বাসন। গরম চাপটি ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমরা কিছুই খেতে পারছি না। আমাদের চোখে অনিশ্চয়তা, ভয় আর অসহায়ত্ব ভর করেছে। কুপিটার সলতের মতো আমরা যুদ্ধ করছি মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে।

মাতুয়াইল, ঢাকা

বন্ধুসভায় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]