বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষায়

বলিহার জমিদারবাড়ির মন্দির। ছবি: লেখক
বলিহার জমিদারবাড়ির মন্দির। ছবি: লেখক

২০১৩ সালের মে মাস। পিচঢালা রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছের ডালে থোকা থোকা আম। যত দূর চোখ যায়, দুপাশের খেতে সোনালি ধান ঝিকমিক করছে। জমিতে কৃষকেরা কাজ করছেন। মাঝেমধ্যে তাঁদের কাছ থেকে পল্লিগানের পাগল করা সুর ভেসে আসছে। কিছু দূর যেতেই চোখে পড়ে রাস্তার একপাশ ঘেঁষে পানিবিহীন মৃতপ্রায় নদী ‘ছোট যমুনা’, যার পেট চিরে শ্রমিকেরা বালু তোলায় ব্যস্ত।

এমন নয়নাভিরাম শ্যামল ছায়ার মধ্য দিয়ে যখন নওগাঁর পাহাড়পুরে পৌঁছাই, তখন বেলা ১১টা। প্রধান গেট দিয়ে ঢুকতেই পাহাড়পুর জাদুঘর। জাদুঘর থেকে ডান দিকে মূল বৌদ্ধবিহার। এটিকে অনেকেই পাহাড়পুর বিহার বলে। তবে খননকালে মাটির একটি সিল থেকে জানা যায়, এটি সোমপুর বিহার। বিহারটি এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম। বিহারে মাটির পাত্রে খলিফা হারুন-অর-রশিদের আমলের রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া যায়। আচার্য অতীশ দীপঙ্কর এই বিহারে কিছু কাল অবস্থান করেছেন। সোমপুর বিহারটি পাল রাজবংশের রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকের শেষ দিকে নির্মাণ করেন। মধ্যদুপুরের প্রখর রোদে চারপাশ খাঁ খাঁ করছে। তাই বলে কি এই অসামান্য প্রত্নকীর্তিকে সামনে রেখে ছায়াতে বসে থাকা যায়? ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার কারুশৈলীর সৌন্দর্য অবলোকনে।

আমাদের দ্বিতীয় যাত্রা নওগাঁর পত্নীতলার আরেক ঐতিহাসিক স্থান দিবর দিঘির ‘দিব্যক জয়স্তম্ভ’। আমরা দিঘির মূল দরজায় পৌঁছানো মাত্রই একটি কাঠবিড়ালি অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তার ছোটাছুটি দেখে বোঝা গেল, আমরা আসাতে তারা খুব খুশি। দেবদারুগাছের মধ্য দিয়ে দিঘির পাড়ে যেতেই মাতাল হাওয়া তার অস্তিত্বের জানান দেয়। প্রায় ৫০ বিঘা জায়গার গোলাকৃতি দিঘিটির চারদিকটা স্টেডিয়ামের গ্যালারির মতো সিঁড়ি কাটা। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে স্থানীয় লোকজন ধান-গমের চাষ করেন। দিঘিটির মধ্যখানে নির্মিত আট কোণবিশিষ্ট গ্রানাইট পাথরের এত বড় স্তম্ভ বাংলাদেশে বিরল। কথিত আছে, পাল যুবরাজ রামপাল বরেন্দ্র উদ্ধারের চেষ্টায় রাজা দিব্যকের কাছে পরাজিত হন। দিব্যক এই জয়ের সাক্ষ্যস্বরূপ জয়স্তম্ভটি নির্মাণ করেন।

সোমপুর বিহার। ছবি: লেখক
সোমপুর বিহার। ছবি: লেখক

ওখান থেকে আমরা নওগাঁ-রাজশাহী সড়ক ধরে বাবলাতলী পৌঁছাই। ভ্যানে চড়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে ১০ মিনিট এগোলেই বলিহার জমিদারবাড়ি। ঢুকতেই দ্বিতল তোরণ, যেটা এই জমিদারির আভিজাত্যের পরিচয় বহন করছে। ভেতরে দ্বিতল জমিদারবাড়ি, কালীমন্দির, নাটমন্দির, জোড়া শিবমন্দির, রানির ঘাট, রাজেশ্বরী দুর্গামন্দিরসহ নানা স্থাপনা। মন্দিরের পেছনে দ্বিতল জমিদারবাড়ির লোহার গেটটি বন্ধ। ভাঙা শিক গলিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বাগানে জরাজীর্ণ বসার জায়গা ও কৃত্রিম ঝরনা। এই বাড়িতেই জমিদার কৃষ্ণেন্দ্র রায়বাহাদুরের ‘শরদিন্দু’ প্রেসটি ছিল। আঙিনাতে তো ঢুকলাম কিন্তু ভবনের ভেতরে ঢোকার মতো কোনো ফোকর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎই জানতে পারি, পাশের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে ভবনের চাবি। ওনাকে অনুরোধ করতেই খুলে দিলেন। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে, ভেঙে পড়েছে ছাদ। একসময়ের পরাক্রমশালী জমিদারবাড়ি আজ যেন শ্মশানপুরী।

নওগাঁ ভ্রমণে ঘুরে দেখলাম ঐতিহ্যের আরও কিছু নিদর্শন। মান্দায় কুসুম্বা দিঘির পশ্চিম পাড়ে ধূসর পাথরের ‘কুসুম্বা মসজিদ’, সুলতান গিয়াস উদ্দীন বাহাদুর শাহের আমলে নির্মিত। দেয়ালের গায়ে লতাপাতার নকশা, মিহরাবে আঙুরগুচ্ছ ও লতার অলংকরণ রয়েছে।

বলিহার জমিদারবাড়ির দ্বিতল ফটক। ছবি: লেখক
বলিহার জমিদারবাড়ির দ্বিতল ফটক। ছবি: লেখক

‘দুবলহাটি রাজবাড়ি’র দুটি অংশ। প্রথমে আবাসিক ভবন আর দ্বিতীয় অংশে মন্দির। ধামইরহাটে ‘মাহিসন্তোষ’ বর্তমানে একটা মাঝারি আকারের পাঁচিলঘেরা দুর্গ। এখানে রাজবাড়ি, বারোদুয়ারি নামের ঢিবি, পুকুর-দিঘি এবং একটা মাজার রয়েছে। পতিসরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত ‘কুঠিবাড়ি’। কবিগুরু এখানে বহুবার এসেছেন। এর পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে কবির প্রিয় ‘নাগর’ নদ।

বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে এখন শুধু পুরোনো স্মৃতিগুলোই বারবার উল্টেপাল্টে দেখি। অপেক্ষায় আছি, কবে এই অশুভ দানব পৃথিবী ছেড়ে যাবে। মানুষ ফিরে পাবে তার স্বাভাবিক গতি, পৃথিবী ভরে উঠবে নতুন জীবনের জয়গানে। আবারও বেরিয়ে পড়ব নতুন কোনো অজানার খোঁজে।

প্রিন্স শাহ আলম: সাংগঠনিক সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ।

বন্ধুসভায় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]