দায়িত্ব!

লেখিকা
লেখিকা

ঘটনাটা বেশ আগের। তখন কার্জন হলের বিজ্ঞান কারখানার দোতলায় আমাদের ক্লাস হতো। দুটো ক্লাসরুম আর একটা ল্যাব মিলিয়ে ছোট্ট একটা নতুন বিভাগ জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন সংযোজন। বিভাগের শিক্ষক আখন্দ স্যার, নাজমুল স্যার, জেসমিন ম্যাডাম আর আধো শিক্ষকেরা আমাদের কাক বাবা-মার মতো আগলে রাখেন। আর আমাদের ব্যাচে আমরা মাত্র তেরোজন। হরিহর আত্মা। সব মিলিয়ে একটা পাঠশালা পাঠশালা ভাব আছে। সারা দিন এখানেই কেটে যায় ক্লাসের পর ক্লাস আর বিকেলের ল্যাব করে।

এমনই একদিন। সকালের দুই ক্লাসের মাঝে এক ঘণ্টার ফারাক। দুই বন্ধু হিমেল আর আমি কার্জন হলের পুকুর পাড়ে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি করছি। হঠাৎ জিয়োলজির সাদা বিল্ডিংয়ের পাশ থেকে ছয়-সাতটা কুকুরের বাচ্চাকে উঁকি দিতে দেখলাম। প্রত্যেকেই নাদুসনুদুস। বাবা কুকুর আর মা কুকুর তাদের নিয়ে আশপাশটা চেনাতে বের হয়েছে। বাবা কুকুরটা শক্তপোক্ত চেহারার। মাটাকে কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তাদের দুজনকে লাগছে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। হিমেল আর আমি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে তাদের শোভাযাত্রা উপভোগ করছি আর চানাচুর খাচ্ছি।
আমাদের দুই বন্ধুর একটা ব্যাপারে খুব মিল। তেলাপোকা, মাকড়সা, ছ্যাঙ্গা ও বিছা ইত্যাদি কিছু পোকামাকড় ছাড়া প্রাণিজগতের বাকি সদস্যদের প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসা কাজ করে। একবার নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে গিয়ে আমরা একবার নীল চোখের একটা বিড়াল ছানা কুড়িয়ে পেলাম। কেউ তাকে নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়। কেউ মালিকানাও দাবি করল না। এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম এর বাবা-মাকে কেউ দেখেছে কিনা। তিনি অত্যন্ত অনিচ্ছাভরে উত্তর দিলেন, ‘মনে কয়, মাও-বাপ ফালায় গ্যাছে গা, আবার মইরাও যাইতে পারে, কিসুই কইতে পারি না’। যদি নাই কইতে পারেন তাহলে দুই দুইটা হাইপোথিসিস দিলেন ক্যান, পিথাগোরাস সাহেব? যত্তসব! মনে মনে বললাম আর কী কথাগুলো। বিড়ালটাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম আমরা। আমাদের দারোয়ান তাকে খাবার দাবার দেবে এ রকম ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কয়েক দিন পর কাঁটাবনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, দেখি বিড়ালটা কাঁচুমাচু হয়ে ছোট একটা খাঁচায় বসে আছে। মানুষ কেমন! সব বেচে দিতে চায়। ভারী মন নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম সেদিন।
যা হোক, ওই ছয়-সাতটা কুকুরের বাচ্চার মধ্যে থেকে বাদামি রঙের বাচ্চাটাকে দলছুট হয়ে যেতে দেখলাম। ভয় পাওয়া চেহারা নিয়ে সে রাস্তার পাশের ঢালু জায়গাটায় আশ্রয় নিয়েছে। হুসহাস করে কয়েকটা গাড়ি চলে গেল। বাচ্চাটা কেঁপে উঠল। রাস্তাঘাটের ব্যস্ততার সঙ্গে সে পরিচিত নয়। রিকশা বা গাড়ির নিচে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যেতে পারে। চিন্তা করে শিউরে উঠলাম। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হবে। চিন্তাটা হিমেল আর আমার মধ্যে একই সঙ্গে কাজ করল। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম। তাকে কেমন করে ধরব এটা একটা সমস্যা। কামড় দিয়ে দিতে পারে। পোষা বিড়ালের আঁচড় খেয়ে পাঁচটা ইনজেকশন নিয়ে বাঁকা হয়ে পড়ে থাকতে হয়েছে গত বছর। আর কয়েক দিন আগে ল্যাবে ইঁদুরের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে মারাত্মক কামড় খেয়েছি। সুতরাং কুকুর শিশু উদ্ধারের মহান দায়িত্ব একা হিমেলকে কাঁধে নিতে হবে। হিমেল উবু হয়ে ওড়না হাতে পেঁচিয়ে বাচ্চাটাকে ধরতে গেল এমন সময় কোত্থেকে এক লোক ছুটে এসে বলল, ‘কাঁটাবনে নিতে পারলে এক্কেরে পাঁশ শ।’
দারোয়ান কিংবা মালি হবে হয় তো। ব্যাটা কী আশা করে, আমরা বাচ্চাটা ধরে তার হাতে দিয়ে দেব আর সে কাঁটাবনে বেচে দিয়ে এসে পাঁচ শ টাকার হাওয়া খেতে থাকবে? কিছুটা বেপরোয়া হয়ে ছানাটাকে খপ করে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিল হিমেল। তার সাহসিকতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কাঁধের ব্যাগটা আমার বাম কাঁধে ঝুলিয়ে নিলাম। সে একটু নির্ভার থাকুক। কুকুরটার চোখেমুখে এখন নিরাপত্তার ছাপ। তার চিন্তা কেটে গেছে। পশুপাখিদের অনুভূতি আমি কীভাবে যেন বুঝতে পারি। খালি মানুষেরটা পারি না। কারণ তারা জটিল প্রাণী।
কোলে নেওয়ায় বাচ্চাটা একটুও ট্যাঁ ফোঁ করল না। তাকে একটু আদর করে দিলাম মাথায় হাত বুলিয়ে। মখমলের মতো তুলতুলে। পিটপিট করে আবার তাকাচ্ছেও আমার দিকে। মায়ার চোটে আহা উঁহু করতে করতে হিমেল আর আমি একেবারে কাত। গুলুগুলু বুলুবুলু কত কী যে বলতে থাকলাম। কার্জন হলের লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। আমাদের তাতে খুব একটা কিছু আসে যায় না। জিয়োলজি ডিপার্টমেন্টের পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া জংলা জায়গাটায় ছেড়ে দিয়ে আসলাম তাকে। সেখানে তার আরও কয়েকজন ভাই-বোনের দেখা পাওয়া গেল। আমরা মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে আসলাম। দুজনের মুখে রীতিমতো বিজয়ীর হাসি।
কিন্তু এই হাসিটা মিলিয়ে যাওয়ারও সময় পেল না। হিমেল একটা কুঁইকুঁই শব্দ শুনতে পেল। আমার কানে কিছুই ধরা পড়ল না। আমি সারা জীবনই কানে কম শুনি। ইদানীং সেটা আরও বেড়েছে। কুকুর পরিবারের আরেক নয়া সদস্য ড্রেনে পড়ে গিয়ে কাঁদছে। বোধ হয় ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ’-এর মতো ‘অ্যারাউন্ড দ্য কার্জন হল ইন ওয়ান ডে’ টাইপের কোনো অ্যাডভেঞ্চারে নেমেছিল। এখন বিরাট ফাঁপরে পড়েছে। জাগতিক সব পশুপাখির প্রতি প্রগাঢ় মমতায় আমরা আরেকবার আপ্লুত হলাম। এক টুকরা কাপড় জোগাড় করা হলো। সাবধানে দেখে নিলাম ড্রেনের পানি কতটা ময়লা। অবাক ব্যাপার, পানি টলটলে পরিষ্কার। কাপড়টা হিমেলকে দিতেই সে সেটা দিয়ে পেঁচিয়ে বাচ্চটাকে তুলে আনল। তার ধরন-ধারণ দেখে মনে হলো, প্রায় প্রতিদিনই তাকে দু-চারটা করে কুকুর-বিড়ালের প্রাণ বাঁচাতে হয় এবং এই লাইনে সে পুরোপুরি প্রোফেশনাল। মনে মনে একটা বাহবা না দিয়ে পারলাম না! এই ছানাটাকেও তার আগেরজনের মতো একই জায়গায় ছেড়ে রেখে আসলাম। আসার সময় তাদের বাবা-মায়ের মুণ্ডুপাত করছিলাম দুজনে। কেমন মা-বাপ? ছানা-পোনাদের দু-একটাকে ফেলে ফুলে মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমরা দুনিয়া ভুলে সেগুলোকে উদ্ধার করে বেড়াচ্ছি। আমাদের কী খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নাই? ভাবেটা কী ওরা?
সেদিন বিকেলে ল্যাব থেকে বেরিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আবার চলে গিয়েছিলাম পুকুরপাড়ে। উদ্দেশ্য আবার কেউ আবার হারিয়ে গেল, না ড্রেনে পড়ে গেল সেটা দেখা। সেরকম কাউকে পাওয়া গেল না। পরে ব্যাপারটাকে আমরা দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলাম বলা যায়। আমাদের তৃতীয় নয়ন পড়ে থাকত কার্জন হলের আনাচকানাচে।

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।