অচেনা পথে

রাস্তাতে বিরাট এক বটগাছ, পাশে নিঃশব্দে খালের পানি বয়ে যাচ্ছে। বিশাল একটি শিশুগাছের নিচে দাঁড়ালাম।
রাস্তাতে বিরাট এক বটগাছ, পাশে নিঃশব্দে খালের পানি বয়ে যাচ্ছে। বিশাল একটি শিশুগাছের নিচে দাঁড়ালাম।

আমি আর তাহমিনা আপা চলেছি নড়াইল, মিঠাপুর গ্রামের উদ্দেশে। যশোর বন্ধুসভার বন্ধু মিতুর আম্মা মারা গেছেন। ৭ জুলাই দুপুর নাগাদ খবর পেলাম। মিতুর পাশে দাঁড়ানো মানবিক দায়িত্ব। এটা ভেবেই অচেনা পথে ৮ জুলাই সকাল সাতটায় যাত্রা শুরু করলাম আমরা দুজন। আমি ও তাহমিনা আপা।

নড়াইল পৌঁছে বাস পাল্টে আরও একটি বাস ধরতে হলো। পথে পুলিশ ও মুদিদোকানের মালিকেরা তথ্য দিয়ে আমাদের সাহায্য করলেন। এরপর আরও ২৫ কিলোমিটার ভ্যানে চড়ে মিতুর দাদাবাড়ি মিঠাপুর গ্রামে পৌঁছালাম।
বন্ধুসভায় একদিন মিটিংয়ে বসে মিতুর হাতে দেখলাম একটি বই। জানলাম ওটা ওর বাবার লেখা বই। বইটি হাতে নিয়ে দেখি লেখক পরিচিতিতে আমার স্কুলজীবনের একজন প্রধান শিক্ষকের ছবি। বুঝতে বাকি রইল না যে বইটা আমার সেই স্যারেরই লেখা।
মাত্র তিন মাসের জন্য স্যার আমাদের স্কুল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় যশোরে পোস্টিংয়ে ছিলেন। তিনিই মিতুর বাবা। প্রথমত, মিতু আমার স্যারের মেয়ে, অন্যদিকে বন্ধুসভার বন্ধু ও আমার কর্মস্থল নিউজ নেটওয়ার্কের ফেলো ছিল।

মিতুর দাদাবাড়িতে আমরা বেলা ১১টা ৩৭ মিনিটে পৌঁছালাম। জানলাম সকালে ছোট বোনকে নিয়ে মিতু মামাবাড়িতে গিয়েছে। আমি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ঘরের ভেতরে, স্যারকে প্রথমেই বললাম, আমি আপনার ছাত্রী স্যার।
স্যারের চারপাশে আত্মীয়দের ভিড়। আত্মীয় দুজন আমাদের চেয়ার এগিয়ে বসতে দিলেন। স্যার বললেন, তিনি ২০০৭ সালে ছিলেন যশোরে, আমি বললাম তখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি।
মিতুর সঙ্গে ফোনে কথা বললাম আমরা। সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা জানা ছিল না, শুধু বলেছিলাম, মিতু, সুস্থ হয়ে যশোরে ফিরে এসো। পড়ালেখা শেষ করতে হবে তোমাকে। মিনা আপাও কথা বললেন মিতুর সঙ্গে। এর মাঝে স্যার সবাইকে ডেকে বলছিলেন, ‘এই দেখো, আমার ছাত্রী, এটা আমার ছাত্রী।’

গল্প করতে থাকলাম ভ্যানচালক কিশোর হৃদয়ের সঙ্গে আর গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।
গল্প করতে থাকলাম ভ্যানচালক কিশোর হৃদয়ের সঙ্গে আর গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।

অচেনা পথ। আবার ফিরতে হবে যশোরে, অন্যদিকে আমি নিজের অফিস ফেলে চলে এসেছি এবং তাহমিনা আপাও ব্যবসায়িক কাজ ফেলে এসেছেন।
এ কারণে আমাদের চলে আসার তাগিদ ছিল বেশি। আসার আগে স্যারকে বললাম, একটা ছবি তোলার অনুমতি দেবেন স্যার? আর কবে দেখা হবে জানি না। স্যার নিজে তাঁর পাশের চেয়ারে আমাকে বসতে বললেন। বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি।
বললাম, আমি এখনো সেই যোগ্যতা অর্জন করিনি যে আমি আমার হেড স্যারের পাশে, চেয়ারে বসতে পারি স্যার। স্যার বললেন, তুমি বসো, আমি তো অনুমতি দিচ্ছি। যথারীতি আরও কিছু কথা চলতে থাকল আমাদের সবার। স্যার যশোরে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির খোঁজ নিলেন। মিতুর চাচাতো ভাই ভীষণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন আমাদের।
ফেরার জন্য উঠে পড়লাম। তখন বলেছিলাম, স্যার, বহুদিন কোনো শিক্ষকের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার সুযোগ হয়নি, যদি আপনি সালাম করার সুযোগ দিতেন, আর আমার জন্য দোয়া করবেন। স্যার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। ২০১২ সালের এসএসসি শেষ করে স্কুল ছাড়ার সাত বছর পর শিক্ষকের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বেরিয়ে এলাম মিতুর বাসা থেকে।
জীবনে এই প্রথম আমি দেখছি স্ত্রী বিয়োগে শোকের চাদরে মোড়া এক শিক্ষক। কেমন হয় সেই শোক নিরাশা, হতাশার পাহাড়! এমন মুহূর্তে প্রাক্তন এক ছাত্রী হিসেবে স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে একটু হলেও শোককে ভোলাতে পেরেছিলাম হয়তো।
ফেরার পথে মিতুর চাচাতো ভাই ভ্যান ঠিক করে দিলের মিঠাপুর পর্যন্ত আসার জন্য। মিনা আপু আর আমি সারা রাস্তা গল্প করলাম। গল্প করতে থাকলাম ভ্যানচালক কিশোর হৃদয়ের সঙ্গে আর গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। রাস্তাতে বিরাট এক বটগাছ, পাশে নিঃশব্দে খালের পানি বয়ে যাচ্ছে। বিশাল একটি শিশুগাছের নিচে দাঁড়ালাম। ছবি তুললাম, সেলফি নিলাম দুজন।
বাসা থেকে ভেজে আনা পপকর্ন খেতে খেতে পৌঁছালাম বাসস্ট্যান্ডে। যেহেতু করোনা চলছে, আমরা খুবই সতর্ক ছিলাম, তারপরও দীর্ঘপথ ভ্রমণ করে মিনা আপা ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে নড়াইল যাওয়ার পথে দুবার বাস অ্যাকসিডেন্ট করতে যাচ্ছিল। তখন বারবার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছিল আমার। এভাবে অচেনা পথ পাড়ি দিলাম আমরা দুজন, অনেক নতুন অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও অনুভূতি নিয়ে ফিরে এলাম চেনা শহর যশোরে।

অনুষ্ঠান সম্পাদক, যশোর বন্ধুসভা।

বন্ধুসভায় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]