মহামারিতে মধ্যবিত্তের ঈদ

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

‘আমাদের ঈদের গরু কবে কেনা হবে বাবা?’ পাশের বাড়ির টুম্পাদের কুরবানির জন্য কেনা ইয়া বড় গরু দেখে বাড়ি ফিরে এ কথা জানতে চায় ছোট্ট মুনতাহা। মেয়ের প্রশ্নে হকচকিয়ে যান বাবা! মা-বাবাসহ ছয় সদস্যের পরিবার তাদের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মুনতাহার বাবা একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতেন। কোনোরকমে খেয়ে-পরে কেটে যেত তাঁদের দিন। প্রতিবছর ঈদে প্রতিবেশীরাসহ যৌথভাবে অল্প দামের একটা গরু কুরবানিও দিতেন। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন।

করোনা নামক মহামারির কারণে থমকে আছে গোটা বিশ্ব। চলমান মহামারি পরিস্থিতির কারণে মুনতাহার বাবার কর্মস্থলে কিছুদিন ছুটি থাকলেও পরে আবার কাজ শুরু হয়। কিন্তু শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কারণে চাকরি হারাতে হয় তাঁকে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে কোথাও চাকরি পাওয়াও সম্ভব নয়। দুই মাস ধরে রোজগার বন্ধ থাকায় চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়ে তাঁদের পুরো পরিবার। মুনতাহার দাদা-দাদির ঔষধ আর নিত্যদিনের চাহিদা মেটাতে যৎসামান্য সঞ্চিত অর্থও শেষ। এমন পরিস্থিতিতে কুরবানির কথা চিন্তা করা যেন আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

শুধু আজ নয়, গত কয়েক দিনে সে অনেকবার এ বিষয়ে নানা রকম প্রশ্ন করেছে। যার বিপরীতে বাবার আহতদৃষ্টি আর তার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য মায়ের প্রাণপণ চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। মেয়ের বারংবার প্রশ্নে অতিষ্ঠ মা বাধ্য হয়ে তাদের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করছিল ছোট্ট অবুঝ মেয়েকে। ‘তবে এবার ঈদে কি আমরা গোশত খাব না?’ আকস্মিক প্রশ্ন করে মুনতাহা। ‘কেন নয় মা? অবশ্যই গোশত খাব’—বলে মেয়েকে ভোলানোর চেষ্টা করলেও মা মনে মনে শঙ্কিত ছিলেন। আসলেই তো, কতদিন ভালোমন্দ কিছু খাওয়া হয় না। যেখানে দিনে দুবেলা দুমুঠো ভর্তাভাত জাগাড় করাই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে, সেখানে আবার গোশত! অবশ্য আত্মীয়স্বজন কেউ না কেউ তো একটু গোশত পাঠাবেই। সেই ক্ষীণ আশার আলো থেকেই মেয়েকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা। পাশের রুম থেকে সব শোনেন মুনতাহার বাবা।

ঈদের আগের দিন হঠাৎ করেই মুনতাহার বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই সকালে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেছেন। সন্ধ্যা নামছে অথচ তিনি ফিরে আসেননি। এদিকে চিন্তায় অস্থির বাড়ির সবাই। মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ পরই মুনতাহাকে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢোকেন তিনি। সবার সকল প্রশ্ন ছাপিয়ে স্ত্রীর হাতে গোশতের প্যাকেট তুলে দিয়ে রান্না বসাতে বলেন। তাঁর বিধ্বস্ত চেহারা, ধুলোমাখা দেহ, ফোস্কা পড়া হাত দেখে মুনতাহার মায়ের আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। আসলে মুনতাহার বাবা সারা দিন একটা সাইটে ইট ভাঙার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর গোশত হাতে ফেরাতে মুনতাহার মুখের হাসি দেখে কেটে যায় সারা দিনের সকল ক্লান্তি। এটুকু হাসিই তার মধ্যবিত্ত বাবার মনে এনে দেয় প্রশান্তি।

নুসরাত জাহান: সাধারণ সম্পাদক, কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা