আবৃত্তির কৌশল

বন্ধুসভার অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করছেন তানভিন নাহার।
বন্ধুসভা ফাইল ছবি

আবৃত্তি

আবৃত্তি অর্থ বারংবার পাঠ করা। এই অর্থে কোনো কিছু বারবার পাঠ করাকে আবৃত্তি বলে। আবৃত্তি (Recitation) সাধারণ ধারণায় শ্রোতার সম্মুখে কোনো কবিতা বা বক্তব্য আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে উপস্থাপন করার একটি শিল্প। আবৃত্তি শিল্পমাধ্যমের একটি মাধ্যম। বাংলাদেশ ও কলকাতাতে বাংলা আবৃত্তির চর্চা হয়ে থাকে।

সাহিত্য পদবাচ্যের (কবিতা ও গদ্য) সামগ্রিক রূপকে কণ্ঠস্বরে যথাযথ প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রমিত উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রেখে বিষয়ে ধারণকৃত অনুভূতি, আবেগ, ভাব, গতি, বিরাম, ছন্দ ইত্যাদির সমন্বিত ও ব্যঞ্জনার প্রকাশই আবৃত্তি।

সর্ব শাসত্রানাং বোধাদপি গরীয়সী। যারা আবৃত্তি করবেন তারা এই কথাটি বেশির ভাগ লেখায় দেখে থাকবেন। আবৃত্তি গবেষক রামচন্দ্র পাল দাবি করছেন, ইদানীং এ কথাটি দিয়ে আবৃত্তিকাররা বোঝাতে চাইছেন, শাস্ত্রের মধ্যে আবৃত্তি শাস্ত্র প্রধান। ধারণাটি বর্মের মতো আবৃত্তিকারকে বাঁচাচ্ছে। এতে আত্মতৃপ্তি রয়েছে, তবু এটি অনুসন্ধানযোগ্য। প্রবচনটি বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘সকল শাস্ত্রের মধ্যে আবৃত্তি শ্রেষ্ঠতর।’ এ প্রসংগে অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় কী বলছেন? তিনি বলছেন, ‘সর্ব শাস্ত্রের মধ্যে একটা জিনিসকে বোঝবার আগে আবৃত্তি করা দরকার, আবৃত্তিতে এর রূপ মূর্ত হবে।’ আবার এই কথাটিকে ব্যাখ্যা করলেন শ্রী গোবিন্দ গোপাল। তিনি বলেন, প্রাচীনকালে বেধ পাঠের ব্যাপার ছিল। অর্থের দিকে ততটা দৃষ্টি দেওয়া হতো না। তাদের মত ছিল, যথাযথভাবে উচ্চারণ করে আবৃত্তি বা পাঠ করলেই মন্ত্রের ফল পাওয়া যায়।

প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে আবৃত্তি শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ ছিল। শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বারংবার পাঠ। প্র, পরা, অপ, সম ইত্যাদি যে ২০টি উপসর্গ বাংলায় পাওয়া যায় ‘আ’ তার একটি। ‘আ’ মানে সম্যকভাবে বা সর্বতোভাবে। সে ক্ষেত্রে আবৃত্তির প্রাচীন অর্থটা হয় এ রকম, সম্যকভাবে বা সর্বতোভাবে যা পঠিত বা উচ্চারিত। বৈদিক ভাষা যখন রচিত হয়, তখন লেখার কোনো পদ্ধতি আমাদের জানা ছিল না। বৈদিক কবিরা রচনা করতেন মুখে মুখে এবং সে রচনা কাগজে লিখে রাখার মতোই ধরে রাখতেন মুখে মুখে, আবৃত্তির সাহায্যে। বৈদিক সাহিত্য আবৃত্তির মাধ্যমে যুগে যুগে বাহিত হওয়ার আরও একটি কারণ ছিল। এ প্রসঙ্গে সুকুমার সেন বলেন, লেখাপড়ার চেয়ে আবৃত্তির উৎকর্ষ অধিক। লেখাতে ভাষার সবটুকু ধরা পড়ে না। না কন্ঠস্বর, না সুরের টান, না ঝোঁক। কিন্তু আবৃত্তিতে এসবই যথাযথ বজায় থাকে।

কবিতা

কবিতা ছন্দোময় বিন্যাস, যা একজন কবির আবেগোত্থিত অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা।

আমি মনে করি, কবিতা হচ্ছে কবির চেতন অথবা অবচেতন মনের গুঞ্জরণ। ভ্রমর যেমন হাজার হাজার ফুল থেকে মৌ নিয়ে মধুচাক তৈরি করে, তেমনি কবি প্রকৃতি থেকে নানা রং, রস, রূপ নিয়ে মালা গাঁথেন। শব্দমালা সেলাই করে করে জন্ম নেয় একেকটি কবিতা। কবি যা লেখেন, তা কবিতা। সদ্যোজাত শিশু জন্ম দিতে মায়ের যেমন আনান্দ। কলমপ্রসূত এক একটি কবিতা জন্মদানে কবির তেমন অপার আনান্দ। শুভ্র চেতনার প্রতীক কবিতা। কবিতা আমাদের সচেতন করে। সমাজ গড়ে, দেশ গড়ে, গড়ে ভালোবাসা। বোধের জাগরুক ঘটিয়ে আহ্বান করে সত্যের। সাধারণের অদেখা বিষয়গুলোকে কবি দেখে সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে। কবি দার্শনিক দেখেন বহুদূর। মসৃণ অনুভূতিগুলো সৃষ্টি করে অনেক কিছু। কবিতা কবির আত্মার খোরাক। কল্পনার ভেলায় গা ভাসিয়ে কবি সন্তরণ করেন দিবানিশি।

আবৃত্তিকারের দায়িত্ব

কবির কাজ যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই আবৃত্তিকারের দায়িত্ব শুরু হয়। আবৃত্তিকারের কাজ কবিতাকে রূপ-রং-রসে পূর্ণ করে অধিক গ্রহণের উপযোগী করে তোলা। সাধারণের কাছে কবিতাকে অধিক জনপ্রিয় করে তোলার দায়িত্ব আবৃত্তিকার নিজেই তার কাঁধে তুলে নেন। এ দায়িত্ব কেউ তাকে নিতে বলেন না। অনেকেই বলে থাকেন, ‘আবৃত্তি হচ্ছে পরের ধনে পোদ্দারি।’ বিষয়টি অনেকাংশে ঠিক। কারণ, কবির সৃষ্টি কবিতা নিয়ে একজন আবৃত্তিশিল্পী দর্শক ও শ্রোতার মানসপটে নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন। তাতে কবিতাটি অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাতে আবৃত্তিশিল্পী তৃপ্তি অনুভব করেন।

নির্মাণকৌশল

নির্মাণ শব্দটা মনে হতেই কোনো কিছু তৈরি করা বোঝায়। যেমন একটি অট্টালিকা নির্মাণ হচ্ছে। তা তৈরি করতে নানা রকম নির্মাণসামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যেমন ইট, বালু, সিমেন্ট, রড, পাথর, কাঠ, বাঁশ প্রভৃতি। এগুলো ছাড়া যেমন একটি অট্টালিকা নির্মাণ সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি জিভ, ঠোঁট, চোয়াল, শ্বাসপ্রশ্বাস, উচ্চারণ, ছন্দ, স্বর, ভাব-রস ও শিল্পবোধ ছাড়া কবিতা নির্মাণ সম্ভব নয়। এর প্রতিটি উপাদানের পরিমিতিবোধ জানতে হবে। যার অনুভূতি যত সূক্ষ্ম, যার পরিমিতিবোধ যত মার্জিত, তার কবিতা নির্মাণ তত পরিশীলিত হবে।

আবৃত্তি করার ক্ষেত্রে যে কৌশলগুলো রপ্ত করতে হবে-

১. কবিতা বারবার পড়তে হবে।

২. কবিতার বিষয়বস্তু বুঝতে হবে।

৩. চরিত্র খুঁজে বের করতে হবে।

৪. নারী চরিত্র থাকলে নারীদের পড়া উত্তম।

৫. পুরুষ চরিত্র থাকলে পুরুষদের পড়া উত্তম।

৬. কবিতার চরিত্রে নিজেকে কল্পনায় দেখা।

৭. কবিতাটি কোন পটভূমিতে লেখা হয়েছে, তা জানা।

৮. কবিতার পুরো বক্তব্যকে বুঝে নিতে হবে।

৯. বুঝতে হবে কবিতাকে কীভাবে উপস্থাপন করলে দর্শক-শ্রোতা গ্রহণ করবে।

১০. কবিতার কোথায় কোথায় কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আনা সম্ভব।

১১. কবিতার কোথায় কোথায় থামলে অধিক অর্থ প্রকাশ পাবে।

১২. কোন লাইনে কোন আবেগ আছে।

১৩. কোথায় কোন রস প্রয়োগ করতে হবে।

১৪. স্বরাঘাত, মডুলেশন, ইমফ্যাসিস, ইমোশন, স্ক্যানিং, কালার-টেকচার, পজ, মির প্রভৃতি বুঝতে হবে।

১৫. চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা।

পরিশেষে বলা যায়, উল্লিখিত বিষয়গুলো বুঝে ধারণ করতে হবে। উপাদানগুলোর প্রয়োজন অনুযায়ী সূক্ষ্ম ব্যবহারই কবিতাকে করে তুলবে কালজয়ী। এ ক্ষেত্রে আবৃত্তিকারকে হতে হবে পরিমিতিবোধসম্পন্ন। তাহলেই আবৃত্তি নির্মাণ পরিপূর্ণতা লাভ করবে। কবিতা হয়ে উঠবে শ্রোতা কিংবা দর্শকের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য। আর তাতেই আবৃত্তিকারের সার্থকতা।