চার যুবকের বিলাপ

প্রতীকী ছবি। অলংকরণ: বাবুল হোসাইন সোহাগ

আমরা চার বন্ধু মন্দিরার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছিলাম। ইদানীং আমাদের আড্ডায় মন্দিরাই হয়ে উঠেছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

এর আগে আমরা আড্ডায় রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতাম বেশি। স্বাধীনতার ৩০ বছর পর রাজাকারদের আর রাজাকার বলব কি না, এমন আলোচনায় আমরা মেতে উঠতাম এবং ভাবতাম, কবে কোন যুগে রাজাকাররা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, মা-বোনদের ধর্ষণ করেছিল পাকিস্তান রক্ষার নামে, কাকে খুন করেছিল মুক্তিযোদ্ধার বাবা, ভাই বা চাচা বলে, এসব এখন অলীক ভাবনা। স্বাধীনতার ৩০ বছরে এসব মনে রাখার দরকার নেই। ওদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই উচিত। শুধু বাধ সাধত বাশার। ও এসব ভাবনার প্রবল বিরোধিতা করত। ও ভুলতে পারত না যে ও একজন শহীদের ছেলে। পাকিস্তান আর্মি ওর বাবাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। ও যখন তীব্র ভাষায় বিরোধিতা করত, তখন ওর কণ্ঠস্বর বদলে যেত। কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে উঠত। ওর ওই কণ্ঠস্বর শুনে আমরা চমকে উঠতাম। ভেতরে আমাদের কাঁপুনি উঠত। তবে সেটা অল্প সময়ের জন্য। আমরা ভয় পেতাম না। ওকে থোড়াই কেয়ার করতাম। কারণ আমাদের বুকের ভেতরে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বাহিনী হওয়ার স্বপ্ন ছিল। শুধু যখন ও বলত, ‘তোরা যারা স্বাধীনতাযুদ্ধে পরিবারের কাউকে শহীদ হতে দেখিসনি, তারা বুঝবি না স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য আমাদের ঘৃণা কত প্রবল।’ তখন আমাদের মাথা নত হয়ে যেত। আমরা মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকতাম। আর বাশারের কথার কোনো প্রতিবাদ করতে পারতাম না। কেবলই মনে হতো, ও কঠিন সত্য কথা বলেছে। বাশারের ম্লান, বিবর্ণ, দুঃখ পাওয়া চেহারা আমাদের অনুতপ্ত করে রাখত। কিন্তু সেটাও সাময়িক ভাবনা। আমরা পুনরায় নিজেদের অবস্থানে স্থিত হয়ে যেতাম।

আমাদের আগের মুডে ফিরে যেতে দেখলে ও চেঁচিয়ে বলত, ‘দেশটা যদি স্বাধীন না হতো তাহলে পাকিস্তানিদের জুতা মুছেও ভাত খাওয়ার সুযোগ পেতি না তোরা।’

ওর রূঢ় সত্যি কথায় আমরা আবার বিবর্ণ হয়ে যেতাম। আমরা বুঝতাম, এর চেয়ে বড় সত্য আর হয় না।

কিন্তু সেটা বড় সাময়িক উপলব্ধি। আমরা আবার নিজেদের ভাবনায় ফিরে আসতাম। আর চারজন একদিকে, বাশার ছিল একা। তবু ও মাঝেমধ্যে এসব কথা বলে আমাদের দাবিয়ে দিতে পারত। আমরা তখন ওর সামনে টুঁ শব্দটি করতে পারতাম না। ওর ভেতরে কী যেন একটা আলো ছিল, যেটা আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিত।

এ জন্য ও মাঝেমধ্যে বলত, আসলে তোরা ভালো ছেলে কিন্তু ভুল পথে চলে গিয়েছিস। তোদের মুরুব্বিরাও জানে না, কী করা উচিত।

আমাদের নিরুত্তর দেখলে ও রেগে যেত। চেঁচাত। তারপর দুপদাপ পা ফেলে দূরে চলে যেত।

এর মধ্যে আমাদের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা হয়ে যায়। বাশারকে ওর মা ঢাকায় পড়তে পাঠায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় ও। আমাদের রেজাল্ট তেমন ভালো ছিল না। পড়ালেখায় মনোযোগও ছিল না। আমরা কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা চিন্তাও করি না।

বাশার চলে যাওয়ার পর আমরা চারজন আকস্মিকভাবে একা হয়ে পড়ার যন্ত্রণা অনুভব করে একে অপরকে বলি, কেমন জানি লাগছে-

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

আমার মনে হচ্ছে, চা খেয়ে কোনো টেস্ট পাচ্ছি না।

সিগারেট টেনেও না।

চল, গাবখান সেতুর ওপর গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

নদী দেখবি?

দেখব।

নৌকা?

সেটাও দেখব।

শালা, তোর পেটের ভাত হজম হয় তো?

জলিল দাঁত খিঁচিয়ে কথা বললে আমরা সরাসরি ওর দিকে তাকাই। ও হাতের উল্টো পিঠে মুখটা মুছে নেয়। তারপর সিগারেট জ্বালায় একটা। গোল্ডলিফ। তবে আমরা কেউই ওকে প্রশ্ন করি না যে কেন ও ভাত হজম হওয়ার প্রশ্ন ওঠাল। সিগারেট দু টান দিয়ে বলে, চল।

আমরা চারজন সেতুর কাছে আসি। বিশাল বাহারি সেতু। মনে হয় এই সেতু আমাদের ঝালকাঠি শহরের সঙ্গে মানানসই নয়। তবু আমরা চারজন সেতুর ওপরে উঠে দাঁড়াই। নদী দেখি, নৌকা দেখি, দূরের আকাশ দেখি। আমাদের নিজেদের ভীষণ অবসাদগ্রস্ত মনে হয়। যেন আমরা কত কিছু হারিয়ে ফেলেছি, একটা ভার আমাদের পেয়ে বসে। আমরা বাদাম কিনে চিবুতে থাকি। ওপর থেকে বাদামের খোসাগুলো ফেলে দিই নদীতে। আমরা জানি কাজটা ভালো করছি না। এর ফলে নদীর পানিতে আবর্জনা জমবে, তবু আমরা ফেলতে থাকি। এখন আমাদের সঙ্গে বাশার থাকলে বলত, ‘তোরা হলি গিয়ে জ্ঞানপাপী।’

আমরা চারজন আকস্মিকভাবে হা-হা করে হাসতে থাকি। কারণ আমরা চারজন একই ভাবনা ভেবেছি। যখন-তখন বাশার আমাদের এমন তাড়া করে। নদীর স্রোতে বাদামের খোসাগুলো ভেসে যায়। আমরা রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের পেছনে পড়ে থাকে ঝালকাঠি শহরের ঐতিহ্য। কথিত আছে, এটি একটি বড় নদীবন্দর। একসময় এখানে বড় বড় জাহাজ আসত। বড় বড় জাহাজ বোঝাই বরিশালের বালাম চাল এখান থেকে চলে যেত কলকাতায়। শোনা যায়, একবার রবীন্দ্রনাথের স্টিমার এই বন্দরে থেমেছিল। তিনি এখানকার একটি স্কুলের নামকরণ করেছিলেন। এসব বাশারের গল্প। ও এসব ইতিহাস খুঁজতে ভালোবাসে। আমাদের কাছে এসব গল্প ছিল গুরুত্বহীন। ইতিহাস-ঐতিহ্যে আমাদের বিশ্বাস নাই। এসব দিয়ে জীবন চলে না। আমরা আধুনিক মানুষ।

আমাদের মুখে ‘আধুনিক মানুষ’ শুনলে বাশার হা-হা করে হেসে উঠত। বলত, ‘তোরা জীবনেও জানতে পারবি না আধুনিক মানুষ কাকে বলে। আধুনিক মানুষ সহজ কথা নয়।’

বাশারের মা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। ওর মামা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। এই মুহূর্তে সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে আমরা বাশারকে ঈর্ষা করি এবং মনে করি যে বাশারকে ঈর্ষা করার আমাদের যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা বাশারের মতো অনেক কিছু ঠিকমতো বুঝি না।

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অবসাদ কাটতে থাকে। আমরা সেতুর ওপর থেকে নেমে আসি। অন্ধকারে গাবখান নদী আমাদের প্রিয়তমা হয়ে যায়। আমরা আবার নিজেদের বলয়ে ফিরে আসি। আমরা মনে মনে বাশারকে গাল দিতে দিতে সেইসব খিস্তি খেউড় সুরেলা টানে গানের মতো গাইতে থাকি। আমাদের মনে হতে থাকে যে আমাদের কাজ না থাকার কারণেও আমরা বাশারকে ঈর্ষা করি এবং একজন শহীদের ছেলে বলেও ও আমাদের ঈর্ষার পাত্র হয়।

আমাদের আর লেখাপড়া হবে না। আমরা কিছু একটা করার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠি। ছোটখাটো কোনো চাকরি কিংবা ব্যবসা আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু কোনোটাই আমরা চার বন্ধু জুতমতো দাঁড় করাতে পারছিলাম না। আমাদের বাবারা বিত্তশালী কিংবা কেউকেটা না হওয়ায় আমাদের অসুবিধা হচ্ছিল। আমাদের দিনগুলো দুর্দিন বলে বিবেচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা নারীর সঙ্গ পাওয়ার জন্য লোলুপ হয়ে উঠেছিলাম।

এমন সময় আমাদের মন্দিরার দিকে চোখ যায়।

আড্ডায় বসে একজন যদি বলতাম, ‘মন্দিরার হাসি দারুণ।’ অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে বলত, ‘ঠিক বলেছিস, ওর হাসিতে মুক্তো ঝরে।’

আমি বলতাম, ‘পুরোনো উপমা দিস না। ওকে নিয়ে আমাদের নতুন কথা বলা উচিত।’

‘সত্যি, ওকে পুরোনো উপমায় মানায় না।’

অন্যজন তড়িঘড়ি কিছু বলতে গিয়ে বলে, ‘ওর উপমা ও নিজেই।’

আমি বদরুলের পিঠ চাপড়ে বলি, ‘দারুণ বলেছিস।’ আসলে আমাদের কল্পনা ওকে ছুঁতে পারে না।

ওর টকটকে গায়ের রঙকে আমরা কোনো কিছুর সঙ্গে মেলাতে পারতাম না। ওর লম্বা চিকন আঙুলগুলো ছোঁয়ার স্পর্ধা আমাদের হয়নি। ওর আকর্ষণীয় বাহু দুটো নিয়ে আমরা কবিতার ভাষায় কথা বলতে চাইতাম। আমাদের একজন হবু কবি বন্ধুর কাছে বাহুর উপমা জানতে চাইলে ও চটজলদি বলে দেয়, কেন জসীমউদ্‌দীনের কবিতা আছে না, ‘কচি লাউয়ের ডগার মতো বাহু দুখান সরু।’

আমরা হৈ-হৈ করে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরে বলি, তুই একটা জিনিয়াস শালা।

ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বোকার মতো তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তোদের কী হয়েছে রে?’

‘আমাদের চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে।’

‘তোরা কি একসঙ্গে একজনের প্রেমে পড়েছিস?’

‘হে-হে-হে তা আর বলতে।’

‘শালা তোরা বেকুবের এক শেষ। শালা, কেউ কি এক দড়িতে গলায় ফাঁস দেয়?’

‘ভাগ এখান থেকে। নইলে প্যাঁদানি খাবি। উপদেশ ঝাড়ার আর মানুষ পাওনি শালা।’

আমাদের কবি-বন্ধু এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে স্থান ত্যাগ করে। কোনো কথাও বলে না। আমরা আবার নিজেদের মধ্যে মশগুল হয়ে উঠি। এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে যেতে যেতে আমরা বুঝতে পারি যে মন্দিরাকে কেন্দ্র করে আমাদের ভাবনা নিজেদের ওপরের দিকে না তুলে ক্রমাগত নিচের দিকে চলে যাচ্ছিল। আমরা ভাবতাম, আমরা কেউই মন্দিরার উপযুক্ত নই। তখন আমাদের মধ্যে প্রতিহিংসা জাগত, আমরা ভেতরে ভেতরে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতাম।

তবু আমরা ওর কলেজে যাওয়ার পথের ধারে দাঁড়িয়ে গুলতানি করার সময় ওকে ঘিরে নানা মন্তব্য করতাম। বুঝতাম ও বিরক্ত হচ্ছে, কিন্তু সেটাই ছিল আমাদের আনন্দ। মন্দিরা আমাদের দিকে ঘুরেও তাকাত না। শুধু ও চলে যাওয়ার পর অনুভব করতাম, ওর ধবধবে গায়ের রঙের ছায়া লেপ্টে আছে রাস্তার ওপর। ওই ছায়া হলদি-কুঁচ ফুলের মতো আমাদের বুকে লেপ্টে থাকত।

আমরা চারজনে ভেবে দেখেছি যে এই একটি ফুলের সঙ্গেই মাত্র আমরা ওর তুলনা করতে পারি। শরতে এই ফুলের পাতা ঝরে, ফল পাকে হেমন্তে আর ফুল ফোটে বসন্তে। আমরা দেখছি মন্দিরার শরীরে এখন দারুণ বসন্ত। সুন্দরবনের ঝোপঝাড়ে এই ফুল দেখে আমরা চার বন্ধু এই একটি ফুলের সঙ্গেই মিলাতে পেরেছি। যেন আমরা আর কোনো ফুল চিনিই না।

দিনের পর দিন গড়ায়। ওকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আমাদের বুকে তৃষ্ণা জেগে উঠলে আমরা চারজনে চায়ের দোকানে ঢুকতাম। চায়ের সাথে সিগারেটের গুলতানির সময় আমি মনে মনে বলতাম, ‘মন্দিরা তুমি আমার হও।’

আমি জানি এই একটি কথা জলিল, কাদের আর বদরুলও মনে মনে বলে। আমরা জানি মন্দিরা আমাদের হওয়ার নয়।

ও বামুনের মেয়ে। ওরা সাত ভাইবোন। ও সবার ছোট। সবাই ওকে আগলে রাখে। গেল বছর ওর বাবা মারা গেলে আমরা শ্মশানঘাটে গিয়েছিলাম। আমরা তার মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছি, তা নয়। বয়স হয়েছিল, মরবেই, এমন একটা ভাব ছিল আমাদের মাঝে। আমরা মন্দিরার বাবার চিতার আগুন জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরার অসহায়ত্বের কথা প্রবলভাবে জেগে ওঠার বিষয়ে ভাবছিলাম। কিন্তু তেমন কিছু আমরা লক্ষ করি না। বেশ ভালোভাবে শ্রাদ্ধ হয়ে যায়। বেশ অনেক দিন মন্দিরা কলেজ যায়নি। তারপর আবার যাতায়াত শুরু করে। লক্ষ করি, ও বুঝি আরও শান্ত হয়ে গেছে। আগে বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ফিরত। এখন সেটাও করে না। নাজমার হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে যায়। ওর জন্য আমাদের বুকের ভেতরে নমনীয় ভাব জাগে। আমরা অস্বস্তি বোধ করি।

একদিন রাস্তায় যখন আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন মন্দিরার বড় ভাই সরাসরি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘তোমরা কী চাও?’

এমন আকস্মিক আক্রমণে আমরা প্রথমে বিমূঢ় হয়ে যাই। পরে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বলি, ‘কী চাই মানে?’

‘তোমরা মন্দিরার পেছনে লেগেছ কেন? ভেবেছ, আমরা কিছু বুঝতে পারি না? বেশি বাড়াবাড়ি করলে থানায় ডায়েরি করে রাখব।’

আমাদের রক্ত মাথায় ওঠে। আমরা প্রথমে মন্দিরার ভাইকে গালি দিই। তারপর চিৎকার করে বলি, ‘আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করলে দেশ ছাড়তে বাধ্য করব।’

‘কী, কী বললে? আর একবার উচ্চারণ করলে জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব। তোমরা রাজাকার গোষ্ঠী, তোমরা দেশ ছাড়ো। বাপের ভিটা পাকিস্তানে যাও। আমরা এই দেশের সঙ্গে বেঈমানি করিনি। আমরা দেশ ছাড়ব না।’

মন্দিরার ভাই রাগে-উত্তেজনায় তোতলাতে থাকে। আমাদের চারপাশে লোক জমে যায়। একজন বয়স্ক মানুষ মন্দিরার ভাইকে টেনে নিয়ে বলেন, ‘থামুন তো দিলীপ বাবু। আপনি আর কাজ পাননি এই বখাটেদের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন। চলুন, বাড়ি চলুন।’

‘আপনি ছাড়ুন, আমি ওদের দাঁত ফেলে দেব।’

‘আহ্‌ কী পাগলামি করছেন। ওরা হলো গিয়ে ভীমরুলের চাক। একটাকে ছোঁবেন কি তো এক হাজারটা ছুটে আসবে।’ লোকটি মন্দিরার ভাইকে সরিয়ে নিয়ে যান। আমরা সেই যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর সাহসের পরিমাপ করি। তারপর ভাবি, এটা নেহাতই শূন্যে আস্ফালন। দেখে নেব বলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করি আমরা চারজন। আমাদের আশপাশে দাঁড়িয়ে যারা তামাশা দেখার জন্য ভিড় করেছিল, তারা একে-দুয়ে চলে যায়। আমাদের বয়সী দু–একজন বলে, ‘ছেড়ে দিলি কেন? সাহসটা একটু বেশি দেখিয়েছে না? ওদের কি পায়ের নিচে মাটি আছে?’

আমাদের ভেতর এক শীতল প্রবাহ বয়ে যায়। আমরা কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে জায়গা বদল করার জন্য হাঁটতে থাকি। শেষে গাবখান নদীর ধারে এসে দাঁড়াই।

এর মাসখানেক পর আমরা বাশারের মৃত্যুর খবর পাই।

ঢাকার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরিত হলে স্প্লিন্টারের আঘাতে বাশার নিহত হয়। ওর মৃত্যুতে আমরা খুব দুঃখ পাই। ও যে একটা ভীষণ ভালো ছেলে ছিল, এটা আমাদের বারবার মনে হয়। তিন দিন পর ওর লাশ বাক্সবন্দী হয়ে ঝালকাঠিতে এলে শহরের মানুষ ভেঙে পড়ে ওদের বাড়িতে। সবাই কাঁদতে থাকে। ওর মা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। মাঝে মাঝে চিৎকার করে ওঠেন। আবার অজ্ঞান হয়ে যান। আমরা ওর মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস পাই না। নিজেদের ভেতরের মর্মযাতনায় আমাদের বুক ফেটে যায়।

খবর পেয়ে মায়ের সঙ্গে মন্দিরা আসে ওদের বাড়িতে। বাশারের মা মন্দিরাকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকেন। এই দৃশ্য দেখে আমাদের ঈর্ষা হয়। দুঃখের মাঝেও আমরা ক্রোধ দমন করতে পারি না। এত লোক, বিশেষ করে অনেক মেয়ে থাকতে মন্দিরাকে ধরে কাঁদতে হবে কেন, তা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা এই দৃশ্য না দেখার জন্য বাইরের বড় আমগাছটার নিচে এসে দাঁড়াই।

এর মধ্যে ঠিক হয় যে বাশার হত্যার বিচার চেয়ে লাশ নিয়ে মিছিল হবে। তারপর জানাজা পড়ে ওকে কবর দেওয়া হবে। বাশারের মায়ের ইচ্ছায় কবর হবে বাড়ির আঙিনায়।

অন্যরা যখন কবর খোঁড়ার আয়োজন করে, তখন লাশ নিয়ে মিছিল করে শহরবাসী। গর্জে ওঠে সবার কণ্ঠ, বাশার হত্যার বিচার চাই—মৌলবাদীরা নিপাত যাক। আমরা মিছিলের পিছু পিছু শহর প্রদক্ষিণ করি। বাশারের জন্য আমাদের অনুভব ছিল অকৃত্রিম। ওকে আমরা খুবই ভালোবাসতাম। আমরা স্লোগান উচ্চারণ করি না। শুধু মাথা নিচু করে হেঁটে যাই। যারা আমাদের বখাটে বলে গালি দেয়, তাদের সামনে আমাদের চেহারা স্পষ্ট হয় না।

মিছিল থেকে ফিরে এসে আমরা দেখতে পাই মন্দিরা ওর মাকে নিয়ে চলে গেছে। আমরা স্বস্তি বোধ করি। ওর উপস্থিতি আমাদের ক্রোধ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু মন্দিরা বাশারের মায়ের কাছে যে ভালোবাসা পেয়েছে, আমরা সেটা পাব না। আমরা বাশারের বন্ধু ছিলাম, সেটাও ওর মা পছন্দ করতেন না।

আমরা বাশারের বাড়িতে যেতে পারতাম না। কখনো বাশার আমাদের সঙ্গে যেটুকু কথা বলত সেটুকুই ছিল ওর সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব।

কবর দেওয়া হয়ে গেলে আমরা ফিরতে থাকি। শহরের সরু রাস্তাগুলো আমাদের কাছে আরও সরু হয়ে যেতে থাকে। যেন শহরের রাস্তায় কবরের নীরবতা নেমে এসেছে। আমাদের ভয় করে। আমরা দ্রুত হাঁটতে থাকি। আমরা দুটো রিকশা নিয়ে গাবখান নদীর ধারে এসে দাঁড়াই। রিকশাওয়ালা ভাড়া চাইলে আমরা গলা ধাক্কা দিয়ে ওদের বলি, ‘বাঁচতে চাইলে ভাগ বেটারা। নইলে জবাই করে নদীতে ভাসিয়ে দেব।’

ওরা এক মুহূর্ত আমাদের দিকে তাকিয়ে নীরবে রিকশা নিয়ে চলে যায়। আমরা হা-হা করে হাসি। আমরা এভাবেই এ শহরে বাস করি, যেমন খুশি তেমন। আসলে বাশারের সঙ্গে কি আমাদের বন্ধুত্ব ছিল, ও তো আমাদের কেবলই উপদেশ দিত। এটাকে কি বন্ধুত্ব বলে? আমরা তো জানি বন্ধুত্ব বড় জিনিস। শহরের মাদী-বাচ্চারা ওর হত্যার বিচার চেয়েছে। কে ওর হত্যার বিচার করবে? তেমন মানুষ কি আছে এ দেশে? ওর বাপের হত্যারই তো বিচার হয়নি। অপরাধীরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়। তাহলে ফুঃ! আসলে এমন বালখিল্য বিষয় নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলে। আমরা যে টাকা কটা রিকশাভাড়া দিতে পারতাম, সেগুলো পকেট থেকে বের করে বাদাম কেনার জন্য ছোকরাটাকে কাছে ডাকি। ও কাছে এলে সবাই এক মুঠি করে বাদাম ওর ঝুড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে ওকে ভাগিয়ে দিই। ও কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। ক্ষণিকের জন্য আমাদের অনুতাপ হয়, কিন্তু সেটা বড়ই ক্ষণিকের। আমরা এসব পাত্তা না দেওয়ার জন্য অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করি। পরবর্তী কয়েক দিন দেখি বাশারের মৃত্যুর কারণে শহর থমথমে হয়ে আছে। আমরা জানি এটা সাময়িক। অল্প কয়েক দিনেই আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এ রকম চলছে দেখে আসছি।

আস্তে আস্তে আমরা মন্দিরার কাছ থেকে দূরে সরে যাই। আমরা ছোটখাটো কাজে ঢুকে পড়ি। আমরা চারজন একটি নির্দিষ্ট সময় ছাড়া আর একসঙ্গে হতে পারতাম না। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। হয়তো এভাবেই যেত, যদি না আমাদের জীবনে একটি সুযোগ আসত, যদি না আমরা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারতাম। এমনভাবে সুযোগটা এসে যাবে, তা আমরা ভাবতেও পারিনি।

মাস দুয়েক পরে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘুদের ওপরও নির্যাতন শুরু হয়। আমাদের দৃষ্টিতে ঝিলিক ওঠে। আমরা ভাবি, এখনই দিলীপ বাবুর ওপর এক হাত নেওয়ার সময়।

কিন্তু দিলীপ বাবুর ওপর আমরা আঘাত হানার আগে অন্যরা সে সুযোগ নেয়। আহত হয় দিলীপ বাবু। অন্য ভাইয়েরা বাড়ি থেকে অন্যত্র চলে যায়। বাড়িতে আছে আহত দিলীপ বাবু, তার মা আর মন্দিরা। এই ঘটনা জানার পর আমরা চার বন্ধু একত্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি সিদ্ধান্তে আসি। আর চারজনই একে অন্যকে জিজ্ঞেস না করেই মন্দিরাকে আমাদের করার সিদ্ধান্ত নিই। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠি।

সেদিন আকাশে ম্লান জ্যোৎস্না ছিল। পথে তেমন মানুষ ছিল না। গত কয়েক দিন ধরে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে শহরের রাস্তা প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। দু-একজন কোনো কাজে বাইরে দূরে গেলে দ্রুত বাড়ি ফেরার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে।

আমরা চারজন ধীরেসুস্থে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মন্দিরাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই। দরজার ফাঁক-ফোকর দিয়ে মৃদু আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। আমরা দরজায় কড়া নাড়ি। ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই। আমরা দরজায় লাথি দিই। ভেতর থেকে মন্দিরার মা ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমরা ঘনঘন লাথি দিতে থাকি। শেষে চিৎকার করে বলি, ‘দরজা না খুললে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেব।’

আমরা গালি দিয়ে দরজা খোলার কথা বলি। খুট করে দরজার হুড়কো খুলে দেয় মন্দিরার মা। পুরোনো কালের বাড়ি। পৈতৃক সম্পত্তি বলে অনেক কাল কেউ বাড়িটি সংস্কার করেনি। আমরা মন্দিরার মাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকি। সামনের ঘরেই শুয়েছিল দিলীপ বাবু। সরাসরি তাকেই জিজ্ঞেস করি, ‘মন্দিরা কই?’

মন্দিরাকে বরিশাল পাঠিয়ে দিয়েছি।

‘মিথ্যে কথা।’ আমরা গর্জন করে উঠি। মন্দিরা বাড়িতে আছে। ‘বরিশাল গেলে আমরা জানতাম কবে, কখন ও বরিশালে গেল। বল মন্দিরা কোথায়?’

‘মন্দিরা নেই।’

আমরা একজন দিলীপ বাবুর বুকের ওপর উঠে বসি। বলি, ‘মন্দিরাকে না পেলে তোকে মেরে ফেলব।’

মন্দিরার মা ছুটে আসে। ‘ওকে ছেড়ে দে। বাবারা ওকে ছেড়ে দে। তোদের পায়ে পড়ি, ছেড়ে দে।’

‘আগে মন্দিরাকে নিয়ে আয়। না হলে কাউকে ছাড়ব না।’

‘তোরা আমাকে মেরে ফেল।’

‘যাকে মারার, তাকেই ধরেছি।’

আমরা চারজন দিলীপ বাবুকে ঘিরে ফেলি।

তখন মন্দিরা এসে দরজায় দাঁড়ায়।

‘দাদাকে ছেড়ে দে তোরা।’

‘মন্দিরা!’ মা আর ছেলে একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে।

আমরা হা-হা করে হেসে উঠি। আমরা তো জানতাম ঘটনা এমনই ঘটবে। আমরা ওদের বাড়ির সব ঘরে মন্দিরাকে খুঁজতে চাইনি। আমাদের জন্য কোনো বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারত। সে জন্য আমরা এমন একটি পরিকল্পনা করে এসেছিলাম।

আমরা একজন দিলীপ বাবুর গলা চেপে ধরে থাকি। অন্য তিনজন মন্দিরাকে টেনে বের করে নিয়ে যায়। ও চিৎকার করে না, কাঁদে না। শুধু গায়ের জোর খাটায়। ছুটতে চায় আমাদের কাছ থেকে।

ও একা পারবে কেন? ওকে টানতে টানতে নিয়ে যায় অন্যরা। একটু পর আর একজন চলে আসে। খোলা দরজা পথে শুনতে পাই মন্দিরার মায়ের হাহাকার। দিলীপের তো ওঠারই সাধ্য নেই।

আমরা মন্দিরাকে সুগন্ধা নদীর ধারে নিয়ে আসি।

আমরা চারজন ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। একসময় যখন টের পাই যে ও অজ্ঞান হয়ে গেছে, তখন ওকে ছেড়ে দিই আমরা। ওর মায়ের হাহাকার তখনো আমাদের কানে বাজতে থাকে। আমাদের একবারও মনে হয় না, এই হাহাকার আমাদের মায়েদেরও হতে পারত। আমরা চারজন ম্লান জ্যোৎস্নায় ঘরে ফিরতে থাকি। জানি মায়েরা আমাদের অপেক্ষায় জেগে আছে। আমাদের জিজ্ঞেস করবে, ‘কোথায় ছিলে এত রাত পর্যন্ত? শহরের অবস্থা তো ভালো নয়।’

আমরা হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে বলব, ‘শহর তো আমাদের দখলে মা।’ আমাদের বোকা মায়েরা বুঝবেই না যে কেন আমরা এমন উত্তর দিয়েছি।

আমরা চারজন যে কাজটি করে বাড়ি ফিরছি, তার জন্য আমরা যে খুব আনন্দিত সেটা অনুভব করতে পারছি না। কারণ আমাদের মনে হচ্ছে আজ রাতের ম্লান জ্যোৎস্না আরও বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। গাছের পাতা নড়ছে না। আমরা স্নিগ্ধ বাতাস বুকে টানতে পারছি না। আমাদের ভেতরটা কেমন গুমোট হয়ে আছে।

আমিই প্রথমে নীরবতা ভাঙি। বলি, ‘আমাদের জানি কী হয়েছে রে?’

‘আমারও তা-ই মনে হচ্ছে।’

‘আমারও।’

‘আমারও।’

আমরা চারজন কথা খুঁজে পাচ্ছি না।

একটু পরে বদরুল বলে, ‘যে আনন্দ নিয়ে ঘরে ফিরব বলে আমরা মন্দিরাকে এমন…’

‘হ্যাঁ, বুঝেছি।’ আমার ভেতরেও কোনো আনন্দ নেই। হায় নিষ্পাপ মন্দিরা-

কাদের সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘আমার ভেতরেও কোনো আনন্দ নেই।’

‘তাহলে আমরা কাজটি করলাম কেন?’

আমি চিৎকার করে উঠি। মনে হয় ম্লান জ্যোৎস্না যেন চারদিক থেকে দ্রুত অপসৃত হচ্ছে। নেমে আসছে একটি ঘন কালো ছায়া। বুঝি আকাশে মেঘ জমেছে? নাকি আমাদের দৃষ্টি বিভ্রম? কালো ছায়া আমাদের বুকের ভেতরে নেমে এসেছে।

অনেকক্ষণ পর আমরা চারজনই একসঙ্গে বলি, ‘আমরা অন্যায় করেছি।’

‘আমরা ভীষণ অন্যায় করেছি।’

হায় নিষ্পাপ মন্দিরা-

এইসব স্বীকারোক্তির পর আমরা আবার সাফাই গাইতে শুরু করি। আমরা একটা সুযোগ নিয়েছি। সুযোগটি আমরা তৈরি করিনি। সুযোগটির জন্য আমরা অপেক্ষাও করেছিলাম না। তবু সুযোগটি পেয়ে আমরা ছেড়ে দিইনি। এটাই আমাদের অন্যায়।

এসব বলতে বলতে আমরা চারজনই থমকে দাঁড়াই। আমরা চারজনই কেউ কাউকে জিজ্ঞেস না করে পেছনে ফিরতে থাকি।

আমরা ফিরে যাই মন্দিরার কাছে।

ওকে আমরা যেভাবে ফেলে রেখে গিয়েছিলাম ও সেভাবেই পড়ে আছে। উপুড় হয়ে। আমরা চারজন ওর কাপড় ঠিক করি। তারপর ওকে ঘাড়ে করে বাড়ি নিয়ে আসি। ওর মাকে বলি, ‘নিন, আপনার মেয়ে বাড়ি এসেছে।’

‘মন্দিরা, মন্দিরা এসেছে?’

‘আপনি উঠবেন না দিলীপ বাবু। শুয়ে থাকুন। আপনার শরীর খারাপ।’

দিলীপ বাবু মাথাটা ওঠাতে গিয়ে আবার বালিশের ওপর ফেলে দেয়। ‘উহ’ শব্দ করে নিজের যন্ত্রণা প্রকাশ করে।

ওর মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে, ‘মন্দিরা অজ্ঞান কেন?’

‘ও ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।’

‘ও কাকে ভয় পেয়েছে?’

‘অন্ধকার, অন্ধকারকে।’

‘ওহ, ভগবান।’

‘আপনি একটু শুশ্রূষা করলে ওর জ্ঞান ফিরবে। মা আপনি ওকে বুকে টেনে নিন।’

আমরা চলে যাওয়ার জন্য ফিরে দাঁড়ালে দিলীপ বাবু ক্রোধে ফেটে পড়ে। বলে, ‘দাঁড়াও। ওর সর্বনাশটা করে এই মমতা দেখানোর মানে কী? বলো, কেন ফিরে এসেছো তোমরা?’

আমরা দাঁড়াই না। নিঃশব্দে বেরিয়ে আসি। দিলীপ বাবুর প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারি না । এত কিছু যদি জানবই তাহলে এত নষ্ট মানুষ হলাম কী করে আমরা? আমাদের পা ঠকঠক করে কাঁপে। আমরা চেষ্টা করেও দ্রুত হাঁটতে পারি না। বারবারই পায়ের গতি শ্লথ হয়ে যায়।

রাত কত হবে, জানি না। আমরা ঠিক করি যে আমরা বাড়ি ফিরব না। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকা মায়েদের আমরা এই মুখ দেখাতে চাই না। আমাদের কিছু হয়েছে ভেবে তাদের বুক ভয়ে কাঁপবে। কাঁপুক। আমরা ভাবি, এই খারাপ ছেলেদের জন্য তাদের বুকে যেন কোনো মমতা না থাকে।

আমরা ছমিরুদ্দির চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ওকে ডাকতে থাকি। ও দোকানের পেছনেই থাকে। আমাদের ডাকে ও ঝাপ খুলে মুখ বাড়ায়, ‘কী হয়েছে আপনাদের?’

কিছু হয়নি। তোমার এখানে রাতে থাকব।’ আমরা ঝাপ খুলে ঢুকে পড়ি।

‘কোথা থেকে তাড়ি খেয়ে আমাকে জ্বালাতে এসেছেন এত রাতে?’

আমরা নরম কণ্ঠে বলি, ‘তাড়ি খাইনি ছমির ভাই।’

‘তবে কী খেয়েছেন?’

আমরা চারজন একসঙ্গে বলি, ‘মানুষ।’

ছমিরউদ্দিন কেঁপে উঠে কিছু একটা ধরে নিজেকে সামলায়। আমরা চারজন ওর দোকানের বেঞ্চের ওপর গড়িয়ে পড়ি।