গন্তব্য শ্যামদেশ

ছবি: সংগৃহীত

ভ্রমণে লোভ আমার শৈশবের। জীবনে প্রথম দেশের বাইরে ভ্রমণ ছিল মালয়েশিয়ায়। সেটি ১২ কি ১৩ বছর বয়সে। পরিবারের সঙ্গে সে ভ্রমণ কতটা রোমাঞ্চকর ছিল লেখার ভাষা ছিল না। মনে পড়ে, সে ভ্রমণে গুগল ঘেঁটে নিজেই খুঁজে বের করেছিলাম মালয়েশিয়ার দারুণ সব দর্শনীয় স্থান। আর মালয়েশিয়া ভ্রমণের ঠিক ৮ বছরের মাথায় আমার দ্বিতীয় বিদেশ ভ্রমণ ছিল থাইল্যান্ডে, ২০১৯ সালে। মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই মিলে আমরা ঠিক করি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পর্যটনমুখী ও ঐতিহাসিক শ্যামদেশে ঘুরতে যাব। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে শ্যামদেশ তথা থাইল্যান্ড সম্পর্কে আগে থেকে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়। তবুও ভ্রমণের আগে সেখানকার দর্শনীয় জায়গা, যোগাযোগব্যবস্থা, মুদ্রা, খাবার-দাবার, থাকা-খাওয়ার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিই। সবকিছু নিয়ে আমরা থাইল্যান্ডের বিমান ধরতে প্রস্তুত।

ছবি: সংগৃহীত

আমাদের ফ্লাইট ছিল রাত একটায়। যদিও সকাল থেকে একধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল। কবে বিমান ধরব, সেই ভাবনায় অস্থির ছিলাম। সেই অস্থিরতা থেকেই কিনা আগেভাগেই এয়ারপোর্টে গিয়ে হাজির হয়ে যাই আমরা।

তখনো সন্ধ্যা মাত্র। আমার মা অত্যন্ত গোছানো ও পরিপাটি স্বভাবের। প্রয়োজনীয় মোটামুটি সবকিছুই মা ব্যাগে ক্যারি করেন। এবারও ভুল করেননি। এমনকি ফোনের চার্জের জন্য পাওয়ারব্যাংকটিও সঙ্গে নিয়ে নিয়েছেন। যদিও পাওয়ারব্যাংক নিয়ে সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে ঘটে যায় তুলকালাম কাণ্ড। বিমানবন্দরের কর্মীরা হ্যান্ডব্যাগ থেকে পাওয়ারব্যাংক সরিয়ে অন্যত্র নিতে বলল। রীতিমতো জোরাজুরি করতে হলো তাদের। মা নিরুপায় হয়ে তা মেনে নেন।

ঢাকা থেকে আমরা যখন ব্যাংককে অবতরণ করি, তখন স্থানীয় সময় ভোর পাঁচটা। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি করে আমরা চলে যাই আগে থেকে বুকিং করা সুকুম্ভিত এলাকার হোটেল অ্যাম্বাসেডরে। সবাই ফ্রেশ হয়ে খানিক বিশ্রাম করি। তারপর সকালের নাশতা সেরে বের হয়ে পড়ি শপিংয়ের জন্য। শপিংয়ে যাওয়ার পথে আমি টুকটুকে চড়ার (একধরনের বাহন) বাহানা ধরে বসি। যদিও প্রধান সড়কে টুকটুকে চড়তে বাবার ঘোর আপত্তি আছে। তবে মেয়ের জোরাজুরিতে রাজি হলেন। টুকটুকে করেই আমরা গেলাম কেনাকাটা করতে। সিয়াম প্যারাগন মল থেকে জরুরি কিছু জিনিস কিনে রওনা হই এমবিকে শপিং কমপ্লেক্সের দিকে। বেশ কিছু কেনাকাটা হলো। শপিংমল থেকে হাত ভর্তি করে হোটেলে ফিরে এলাম। কয়েক দিন আমরা ব্যাংককের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে কাটিয়ে দিই। এর মধ্যে একটা বড় আফসোস থেকে যায়। কারণ ফ্লোটিং মার্কেটে যেতে পারিনি। কিন্তু ভ্রমণে তো সব তৃপ্তি মেটানো অসম্ভব। কিছু অতৃপ্তি তো থাকবেই। তাই বলে কি আর ছুটে চলা বন্ধ থাকবে? পরদিন রওনা হলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য ফুকেটের উদ্দেশে।

ছবি: সংগৃহীত

ফুকেট ভ্রমণটা সবচেয়ে বেশি আনন্দদায়ক বলতে হবে। মনে হচ্ছিল যে আমরা সত্যিকার অর্থে ভ্রমণে এসেছি। বিমান থেকেই আমি দেখছিলাম মনোরম সব দ্বীপ। প্রকৃতির লীলা সৃষ্টি যেন ঠিকরে পড়ছে দ্বীপে! ফুকেটে আমাকে অবাক করেছে সুরম্য ও দর্শনীয় মসজিদগুলো। থাইল্যান্ড মুসলিমপ্রধান দেশ নয়। তা সত্ত্বেও এত অসাধারণ কারুকার্যময় সব মসজিদের উপস্থিতি আছে এখানে। প্রতিটি মসজিদে নান্দনিকতা ও শিল্পের ছোঁয়া। সত্যি মনকাড়া দৃশ্য।

ফুকেট উপভোগ করে আমরা আবার ফিরে আসি ব্যাংককে। এবার এখানকার ‘মাদাম তুসো’ জাদুঘর ঘুরে দেখলাম। অনুপ্রেরণার মানুষগুলোর মোমের মূর্তি পেয়ে ছবি তুলতে ভুল করিনি। এদের মধ্যে অন্যতম একজন অপরাহ্‌ উইনফ্রে—মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। পাশে বসে ছবি তুললাম। মনে হলো যেন ‘দা অপরাহ্‌ উইনফ্রে শো’তেই বসে আছি!

ব্যাংকক ঘোরাঘুরির ইতি টেনে পরদিন গেলাম ‘পাতায়া বিচে’। সমুদ্র মানে অপার সৃষ্টি। সমুদ্র মানে সীমাহীন জলতরঙ্গ। উত্তাল তরঙ্গের নৃত্যে আমি বিমোহিত হই। কী মনোরম দৃশ্য—শুভ্র বালি ও নীল পাতায়া সমুদ্রসৈকত! কী দারুণ যুগলবন্দি! পাতায়া ভ্রমণে আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি একজন নিখাদ ভদ্রলোককে। আমাদের গাড়ির চালক। দারুণ একজন মানুষ। তিনি আশপাশের সব এলাকা নিজ দায়িত্বে ঘুরে দেখালেন। এতে করে অনেক জায়গা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেলাম। থাইল্যান্ডের ড্রাইভারদের ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবেও অভিজ্ঞ বলতে হবে।

ছবি: সংগৃহীত

আমাদের থাইল্যান্ড ভ্রমণের শেষ গন্তব্য ছিল পাতায়া বিচ। আট দিনের স্মরণীয় ভ্রমণ শেষ করে আমরা শ্যামদেশের অনিন্দ্য সব স্থানকে পেছনে ফেলে ফিরে আসি নিজ ভূমিতে।

করোনার ঠিক আগে আগে থাইল্যান্ড ভ্রমণ আমাদের কোয়ারেন্টিন জীবনের মানসিক ভ্যাকসিন হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যদিও ২০২০ সালে কথা ছিল আমাদের নতুন কোনো দেশ ভ্রমণের। কিন্তু মহামারি সেখানে বাধ সাধে। তবুও আশা, মহামারি শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে। আবার বেরিয়ে পড়ব কোনো অজানাকে জানতে। হয়তো আবার লিখবো লন্ডন, সিডনি, নিউইয়র্ক, উহান-বেইজিং কিংবা অন্য কোনো নতুন শহর থেকে।

শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়