দেশে করোনা অতিমারি ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে গত বছরের মার্চে। তখন থেকেই মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে ঘরের বাইরে বের হওয়া কমিয়ে দিয়েছে। বিধিনিষেধে দোকানপাটও বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। ঘোরাঘুরি করে কেনাকাটা করাও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তাই বলে কি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্র্যান্ডগুলো ব্যবসা গুটিয়ে বসে থাকবে, আর ভোক্তাদের চাহিদা পূরণ হবে না?

করোনাভাইরাস যখন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন ব্র্যান্ডগুলো বসে থাকেনি। গ্রাহক চাহিদা পূরণে তারা ঠিকই নিজেদের পথ বেছে নিয়েছে। তারা ইন্টারনেটে তথা অনলাইনে নিজেদের পণ্যগুলো বিক্রির প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলে। ক্রেতাদের কাছ থেকে ফরমাশ নিয়ে তাদের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দিতে শুরু করে ব্র্যান্ডগুলো। এর ফলে লকডাউন, অর্থাৎ বিধিনিষেধের মধ্যে দোকানপাট বন্ধ থাকলেও পণ্যের বেচাবিক্রি কমবেশি চালু থাকে। এসব পণ্য অনলাইনে কেনাকাটার অন্য প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমেও বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু এ ধরনের অনেক প্ল্যাটফর্ম বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায়ই গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা কিংবা সময়মতো পণ্য না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ ওঠে। এর কিছুটা আঁচ লাগে নামীদামি ব্র্যান্ডগুলোর সুনামে।

পরিবেশ-পরিস্থিতি ও গ্রাহক চাহিদা বুঝে অনেক ব্র্যান্ড করোনার মধ্যে নিজেদের পণ্য নিজেরা বিক্রি করতে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছে। আবার পণ্য বিক্রিতে মাঝেমধ্যে ছাড়ও দিচ্ছে। ফলে ভোক্তারা ঘরে বসেই বাজারের চেয়ে কম দামে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম থেকে নামীদামি ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য কিনতে পারছেন। অবশ্য বেশ আগে থেকে কেউ কেউ নিজেদের প্ল্যাটফর্মে পণ্য বিক্রি করছিল। তবে এখন প্রায় সব ব্র্যান্ডেরই পণ্য বিক্রির নিজস্ব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, যা তাদের ব্যবসা চালু রাখতে সহায়তা করছে।

সময়ের হাত ধরে চলা

করোনার নতুন স্বাভাবিক (নিও নরমাল) সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সবাই এখন অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে জোর দিচ্ছে। কারণ, এতে পণ্য বিক্রির খরচ কম হচ্ছে এবং যুগোপযোগী ব্র্যান্ড হিসেবে কদর বাড়ছে।

অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সর্বশেষ যোগ হয়েছে নিত্যব্যবহার্য ও ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) উৎপাদন ও বিপণনকারী বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড।

ইউনিলিভারের আগমনকে স্বাগত জানিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামীতে অনলাইনে নিত্যপণ্য বিক্রির প্রবণতা আরও বাড়বে। সবাই পণ্য বিক্রির জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করবে। এতে ব্র্যান্ডগুলোর শোরুম খোলা কমবে। শক্তিশালী ই-কমার্স তথা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গ্রাহক আকর্ষণের চেষ্টা করবে।

ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্র্যান্ড

ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস: দেশে নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস একটি শীর্ষস্থানীয় নাম। করোনার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ই-কমার্সের মাধ্যমে পণ্য বিক্রিতে জোর দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনে ট্রান্সকম ডিজিটালের মাধ্যমে স্যামসাং, হিটাচি, ওয়ার্লপুল, ডেল, এইচপি, ফিলিপসসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি করছে।

ফেয়ার ইলেকট্রনিকস: এটি স্যামসাং মোবাইল ফোন, টিভি, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার ও মাইক্রোওয়েভ ওভেন প্রস্তুতকারক ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান। তারা নিজেরা অনলাইনে পণ্য বিক্রির জন্য চালু করেছে ইস্টোরএফডিএল ও ফেয়ারমার্ট নামের দুটি প্ল্যাটফর্ম। আবার বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেও পণ্য বিক্রি করছে তারা।

জানতে চাইলে ফেয়ার গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা (সিএমও) মেজবাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় আমাদের বিক্রি ২৫ শতাংশ কমেছে। আর ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রি কমেছে ৪০ শতাংশের মতো। তবে এই সময়ে নিজস্ব ই-কমার্স ও অন্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রিতে ১০০ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, করোনার সময়ে ই-কমার্সের মাধ্যমে বিক্রি করা পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো সহজ ছিল। এই সময়ে পরিবার নিয়ে কেউ শোরুমে আসতে আগ্রহী নয়। এই অভিজ্ঞতা আমাদের ভবিষ্যৎ পণ্য বিক্রিতে কাজে লাগবে।’

অন্যান্য ব্র্যান্ড: দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন তাদের ই-প্লাজা ওয়ালটনের মাধ্যমে, আর যমুনা ইলেকট্রনিকস ই-স্টোর যমুনার মাধ্যমে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছে। বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার পণ্য বিক্রি করছে সিঙ্গার বিডির মাধ্যমে।

সবাই নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে পণ্য বিক্রিতে নানা ছাড় দিচ্ছে। ব্যাংকের কার্ড ও মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে কেনাকাটা করলেও অনেক সময় ছাড় মিলছে।

নিত্যব্যবহার্য ও ভোগ্যপণ্য

নিত্যব্যবহার্য ও ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) উৎপাদনকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার অনলাইনে পণ্য বিক্রি করতে চালু করেছে ইউশপবিডি। এই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম থেকে ভোক্তারা দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সহজেই ইউনিলিভারের পণ্য কিনতে পারছেন। এসব পণ্যে মাঝেমধ্যেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

একইভাবে আরও অনেকে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছে। তবে সবাই যে নিজস্ব ই-কমার্স ব্যবহার করছে তা নয়। যেমন দেশীয় নিত্যব্যবহার্য ও ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান স্কয়ার অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছে চালডাল, প্রিয়শপ ও দারাজের মাধ্যমে।

ইউনিলিভারের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান শামীমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউশপবিডিতে আমরা খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি। গত বছরের তুলনায় এবারে অনলাইনে পণ্য বিক্রি তিন গুণ বেড়েছে। আমরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিক্রি আরও বাড়াতে চাই। এ জন্য ইউশপের উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে।’

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য

অ্যাপেক্স, বাটা, বে-সহ দেশে পাদুকা এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ড নিজেদের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছে। এসব প্ল্যাটফর্মে মাঝেমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড় দিয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করছে।

পোশাকের ব্র্যান্ড

পোশাকের বেশির ভাগ ব্র্যান্ডই পণ্য বিক্রির জন্য নিজস্ব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছে। আড়ং, ইয়েলো আগে থেকে এই সেবা দিলেও এখন অন্যরা এগিয়ে এসেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ক্যাটস আই, রিচম্যান, এক্সট্যাসি, ফ্রিল্যান্ড, লা রিভ, অঞ্জন’স, সেইলর ইত্যাদি। এসব ব্র্যান্ডের পোশাক এখন তাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাচ্ছে।

টাকা পরিশোধের উপায়

ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোতে কেনাকাটায় টাকা পরিশোধ করা যায় বিভিন্ন ব্যাংকের কার্ড, বিকাশ, রকেট ও নগদ থেকে। এসব কার্ডে ও এমএফএসে কেনাকাটা করলে অনেকে সময় ছাড় পাওয়া যায়। আবার অনেকে পণ্য পাওয়ার পর টাকা পরিশোধের (ক্যাশ অন ডেলিভারি) সুবিধাও দিচ্ছে।

দেশে বিভিন্ন ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এখন প্রতি মাসে ই-কমার্সে ২২ লাখ বার লেনদেন হয়। আর লেনদেন হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার। এর বাইরে বিকাশ, রকেট, নগদের মতো মোবাইল আর্থিক সেবা ও ক্যাশ অন ডেলিভারি তো রয়েছেই।

ভোক্তাদের চাহিদা

ভোক্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সাইট থেকে কিনলে পণ্যে ভেজালের আশঙ্কা থাকে না। মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে এমন পণ্যও দেয় না তারা। এর ফলে ভুয়া ও ঠকবাজ ই-কমার্সের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিও কমে।

অনলাইনে কেনাকাটা সম্পর্কে রাজধানীর উত্তরা এলাকার বাসিন্দা একরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রচলিত ই-কমার্স থেকে পণ্য কিনলে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়। আর সহজে ও কম সময়ে সমস্যার সমাধান হয় না। তাই এখন কোনো ব্র্যান্ডের পণ্য কেনার আগে তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে কি না, সেটা দেখে নিই। থাকলে সেখান থেকেই কিনি। এতে ভেজাল হয় না, নতুন পণ্য পাওয়া যায়।’

সব মিলিয়ে দেশে ভবিষ্যতে ব্র্যান্ডগুলোর নিজস্ব ই-কমার্সের চাহিদা বাড়বে, এটা নিশ্চিত। এ জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে, যাতে ভোক্তারা সঠিক সময় পণ্য বুঝে পান।