আমদানির পরিমাণ কমেছে ৩%, ব্যয় বেড়েছে ৪১%
দেশের পণ্য আমদানি ব্যয় বিপুলভাবে বেড়েছে। কিন্তু এই আমদানি বেড়েছে ব্যয়ের দিক দিয়ে। পরিমাণে বরং কমেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৩৪৩ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪১ শতাংশ বেশি।
অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে পরিমাণের দিক দিয়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ১১ কোটি ৯০ লাখ টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ কম।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পাওয়া দুশ্চিন্তার কিছু নয়, যদি শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ে। কারণ, কাঁচামাল আমদানি বেড়ে যাওয়া মানে শিল্প খাতে উৎপাদন ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়ে যাওয়া মানে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের আমদানি ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিল্পের কোনো কোনো খাতে কাঁচামাল আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কোনো কোনো খাতে কাঁচামাল আমদানি কমেছে, ব্যয় বেড়েছে। সার্বিকভাবে ব্যয় বাড়ায় পণ্যের দাম বাড়ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হলে পণ্যমূল্য আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আভাস ছিল। কিন্তু যুদ্ধ এখন দীর্ঘায়িত হবে বলে আশঙ্কা। তাতে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমার সম্ভাবনা কম। সেটি হলে আমদানি ব্যয় আরও বাড়তে পারে।মোস্তাফিজুর রহমান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ও সরঞ্জাম আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। তবে আমদানি বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। তুলা আমদানি সামান্য বেড়েছে। তবে ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। সিমেন্টশিল্পের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ক্লিংকার আমদানি পরিমাণের দিক দিয়ে প্রায় ৮ শতাংশ কমেছে। বিপরীতে আগের চেয়ে কম পরিমাণ ক্লিংকার আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ১৬ শতাংশ। একই চিত্র ইস্পাত খাতের কাঁচামালের উৎস পুরোনো জাহাজের ক্ষেত্রেও। অবশ্য পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি অনেকটা বেড়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানি খাতে বাড়তি দামে কাঁচামাল আমদানি করে বাড়তি দামে পণ্য রপ্তানি করা যায়, তাহলে চিন্তার কিছু নেই। দেখতে হবে, রপ্তানিকারকেরা বেশি দাম পাচ্ছেন কি না। আশা করা হচ্ছে রপ্তানি বাড়বে। অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ে তিনি বলেন, কাঁচামালের বাড়তি দামের কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে শিল্পপণ্যের দাম বেড়েছে। চাহিদা যদি কমে যায়, তাহলে ব্যবসায়ীরা উৎপাদন কমাবেন। তাই অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা চাঙা রাখতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
সার্বিক শিল্প ও ব্যবসা পরিস্থিতি নিয়ে আবুল কাসেম খান বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। সারা বিশ্বই এখন মূল্যস্ফীতির সমস্যায় রয়েছে। নতুন করে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মন্দা হলে পণ্যের চাহিদা কমবে। তাই সতর্ক থাকতে হবে।
আমদানি বাড়লে কী অসুবিধা
রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স, বিদেশি বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ও অনুদান—এগুলোই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত। বিপরীতে আমদানি, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, বিদেশভ্রমণ, বিনিয়োগের বিপরীতে লভ্যাংশ বিদেশে নেওয়া—এসব কারণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। কোনো কারণে বৈদেশিক মুদ্রার কোনো উৎস থেকে যদি আয় কমে, বিপরীতে ব্যয়ের কোনো খাতে যদি খরচ বেড়ে যায়, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে টান পড়ে। তখন আবার দেশীয় মুদ্রার মান কমতে থাকে।
বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমছে। বিপরীতে আমদানি বাড়ছে বিপুলভাবে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমেছে। যদিও তা এখনো অস্বস্তিকর পর্যায়ে যায়নি।
চট্টগ্রাম, মোংলাসহ ২৯টি কাস্টম ও শুল্ক স্টেশনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৩৪৩ কোটি ডলার। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় খাত থেকে আয় হয়েছে ৫ হাজার ৭২১ কোটি ডলার। ঘাটতি থাকছে ১ হাজার ৬২২ কোটি ডলার।
সমস্যা হলো, আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে পণ্যের দাম বাড়ছে। নির্মাণ খাতের উপকরণ ইস্পাতের দাম বেড়েছে। সিমেন্টের দাম বেড়েছে। নিত্যব্যবহার্য সাবান, শ্যাম্পু ও খাদ্যপণ্য আটা–ময়দা, তেল, চিনি, ডাল—মোটামুটি সবকিছুর দামই বাড়তি।
শিল্পপণ্য ও নিত্যপণ্যের চট্টগ্রামভিত্তিক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার সিমেন্ট ও সীকম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্য দেশে আনার পর ১২ শতাংশ খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
অবশ্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির চিত্রটি ইতিবাচকই বলা যায়। বেশির ভাগ মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির তথ্য (৭৭টি এইচএস কোড) পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমদানি পরিমাণে ২৭ শতাংশ বেড়েছে। যদিও ব্যয় বেড়েছে ৮২ শতাংশ।
রাজস্ব আয় বাড়ছে
এদিকে আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সরকারের রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। কারণ, শুল্ক–কর আদায় হয় পণ্যের দামের ওপরে শতাংশ হারে। দাম বাড়লে সরকারের আয়ও বাড়ে। এনবিআর চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের যে হিসাব দিয়েছে, তাতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পণ্য আমদানি বাবদ রাজস্ব আদায় ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেড়েছে।
অবশ্য সরকার আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে ইতিমধ্যে কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুন করে গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভা করণীয় ঠিক করতে অর্থ, বাণিজ্য ও বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়িত্ব দিয়েছে। দু-তিন দিনের মধ্যে আলোচনা করে সমন্বিত ব্যবস্থা ঠিক করে তা সবাইকে জানানো হবে।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হলে পণ্যমূল্য আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আভাস ছিল। কিন্তু যুদ্ধ এখন দীর্ঘায়িত হবে বলে আশঙ্কা। তাতে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমার সম্ভাবনা কম। সেটি হলে আমদানি ব্যয় আরও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, ‘এই আশঙ্কা সামনে রেখে আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। এ জন্য খাদ্যনিরাপত্তা ও ডলারের বিনিময় মূল্যের স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।’