উত্থান বড় হলেও পতনটা ছোট

  • পাইকারিতে তেলের দাম কেজিপ্রতি আড়াই-তিন টাকা কমেছে।

  • এক বছরে সয়াবিন তেলের দাম ৪৪%, পামতেল ৫৪% বেড়েছে।

বিশ্ববাজারে গত বছরের শেষ দিক থেকে প্রধান দুটি ভোজ্যতেল পাম ও সয়াবিনের দাম যেন পাল্লা দিয়েই বাড়ছিল। মাঝেমধ্যে অবশ্য কমছিলও। উত্থান-পতনের খেলায় শেষ পর্যন্ত অক্টোবরে দাম ঊর্ধ্বমুখীই থাকে। তবে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কিছুটা সংশোধন হয়েছে। দাম আরও কমার আশঙ্কায় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে পাম ও সয়াবিন তেলের দাম কেজিতে দু-তিন টাকা কমেছে।

দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মণপ্রতি ১০০ টাকা কমে গতকাল বুধবার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৪০০ টাকায়। এতে প্রতি কেজির দাম পড়ে ১৪৪ টাকা ৭০ পয়সা। আর পাম তেল মণপ্রতি ১২০ টাকা কমে গতকাল বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৯৮০ টাকা। কেজিতে দাম দাঁড়ায় ১৩৩ টাকা ৪৪ পয়সা।

খাতুনগঞ্জের আরএম এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার শাহেদ উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে দাম সামান্য সংশোধিত হয়েছে। এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে পাইকারি বাজারে। কেজিপ্রতি আড়াই থেকে তিন টাকা কমেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দাম আট দফায় লিটারে ৪৫ টাকা বেড়েছে।

শহর ও গ্রামে সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে এখন বোতলজাত তেলই বেশি বিক্রি হয়। তবে অধিকাংশ রেস্তোরাঁ ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কারখানায় খোলা ভোজ্যতেল চলে বেশি। ফলে পাইকারি বাজারে দাম কমলেও সাধারণ মানুষ তেমন সুফল পায় না। মূলত ভোক্তাদের সুফল পাওয়া নির্ভর করে বোতলজাত তেলের দাম কমার ওপর।

দেশে রান্না ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে সয়াবিন ও পাম তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২১ লাখ টন। আমদানি করেই এই চাহিদা মেটানো হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার টন পাম তেল, আর ৭ লাখ ৮০ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। সব মিলিয়ে আমদানি হয় ২১ লাখ ৩৬ হাজার টন পাম ও সয়াবিন তেল। এতে ব্যয় হয় ১৮৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে পাম তেল এবং ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করেন এ দেশের ব্যবসায়ীরা। অপরিশোধিত আকারে আমদানি করে কারখানায় পরিশোধনের পর বাজারজাত করা হয়।

বাংলাদেশকে পুরো চাহিদাই মেটাতে হয় আমদানির মাধ্যমে। সে জন্য বিশ্ববাজারে এই দুটি তেলের দামের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। আমদানিকারকেরা বলছেন, বিশ্ববাজারে অন্যান্য পণ্যের মধ্যে সয়াবিন ও পাম তেলের দামে অস্থিরতা বেশি। এখন যেসব চালানের ঋণপত্র খোলা হবে, তা এনে বাজারজাত করতে এক মাসের বেশি সময় লেগে যাবে। আর দাম এত বেড়েছে যে বড় ধরনের সংশোধন না হলে বা দাম কমে স্থিতিশীল না হলে বাজারে তেমন প্রভাব পড়বে না।

জানতে চাইলে ভোজ্যতেলের বড় আমদানিকারক সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম যেভাবে বেড়েছে, সেই তুলনায় সংশোধনটা হচ্ছে খুব সামান্য। বিশ্ববাজারে বড় ধরনের সংশোধন ছাড়া দেশের বাজারে সুখবর আসবে না। বিক্রির চাপে পাইকারিতে দাম কিছুটা কমেছে বলে জানান তিনি।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ মাস ধরে পাম তেলের দাম বাড়ে। গত মাসে দাম বেড়ে প্রতি টন পাম তেল বিক্রি হয় ১ হাজার ৩০৭ ডলারে। একই মাসে সয়াবিনের প্রতি টনের গড় দাম ছিল ১ হাজার ৪৮৩ ডলার। এই দর জাহাজভাড়ার বাইরে। আমদানিকারকেরা জানান, গতকাল বুধবার বিশ্ববাজার থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানিতে জাহাজভাড়াসহ চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত খরচ পড়ার কথা টনপ্রতি ১ হাজার ৪৬০ থেকে ৪৮০ ডলার। একইভাবে অপরিশোধিত পাম তেলের দর পড়ার কথা ১ হাজার ৩৯০ ডলার। এই দর আগের চেয়ে ২০-৩০ ডলার কম।

করোনা কাটিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় গত বছরের শেষ প্রান্তিক থেকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে শুরু করে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি দেড় হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০০৮ সালেও বিশ্ববাজারে উত্থানের সময় সয়াবিন তেলের দর এত বাড়েনি। পাম তেলের দরও ২০০৮ সালের উত্থানের সময়ের কাছাকাছি পৌঁছায়। বিশ্ববাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশেও এ বছর ভোজ্যতেলের দাম আটবার বাড়ানো হয়েছে।

সর্বশেষ গত ১৯ অক্টোবর লিটারে সাত টাকা বাড়িয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গত জানুয়ারিতে এই দর ছিল ১১৫ টাকা। সেই হিসাবে এ বছরে অক্টোবর পর্যন্ত লিটারপ্রতি ৪৫ টাকা বেড়েছে সয়াবিনের দাম।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী গতকাল খুচরায় ব্র্যান্ডভেদে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হয়েছে লিটারে ১৫০-১৬০ টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪ শতাংশ বেশি। এদিন খোলা পাম তেল ১৩০-১৩৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এক বছরে এই তেলের দাম বেড়েছে ৪৮ থেকে ৫৪ শতাংশ।