ঠাকুরগাঁও থেকে গাজীপুর আসতে খরচ দেড় হাজার টাকা

এভাবে খোলা পিক আপে কর্মস্থলে ফিরছেন শ্রমিকেরা।
মাসুদ রানা

গাজীপুরের গাছা এলাকার পোশাক কারখানা সিনথেটিক অ্যাপারেলস লিমিটেডে চাকরি করেন আকমল হোসেন (৪৫)। আরও অনেকের মতো ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলন তিনি। ৫ আগস্ট পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে, এই খবরে ঈদের পর আর গাজীপুরে ফেরার চেষ্টা করেননি তিনি। কিন্তু হঠাৎ ১ আগস্ট থেকে কারখানা খোলার ঘোষণা এলে দ্রুত বাড়ি থেকে কর্মস্থলের দিকে রওনা হন তিনি। বাস-ট্রেন বন্ধ, কিন্তু উপায় তো নেই, চাকরি বাঁচাতে পড়িমড়ি রওনা হন আকমল ও তাঁর স্ত্রী।

আকমল হোসেনের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার ঘানিরহাট গ্রামে। তাঁর স্ত্রী জুলেখা পারভীনও একই কারখানার সুইং সেকশনে কাজ করেন।

শনিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আকমল হোসেনের সঙ্গে কথা হয় গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায়। তিনি জানান, ‘বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ির পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, হঠাৎ বউ বাড়ি থেকে ফোন করে জানায়, টিভির খবরে বলেছে ১ তারিখ থেকে কারখানা খুলে দিয়েছে সরকার।’ সেই খবর শুনে বাড়িতে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বের হন। ঘানিরহাট থেকে পীরগঞ্জ ভ্যানে আসেন—ভাড়া ৫০ টাকা। পীরগঞ্জ থেকে একটি ভটভটিতে ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে এসেছেন বীরগঞ্জ। পরে সেখান থেকে একটি ট্রাকে উঠে সৈয়দপুর হয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী—ভাড়া জনপ্রতি ৩০০ টাকা। পলাশবাড়ী থেকে সিএনজিতে বগুড়ার চারমাথা এসেছেন ১২০ টাকা দিয়ে। সেখান থেকে একটি পিকআপে ১৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে এসেছেন সিরাজগঞ্জ রোডে। এরপর একটি পণ্যবাহী ট্রাকে জনপ্রতি ৫০০ টাকা দিয়ে এসেছেন চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায়। সেখান থেকে ২০০ টাকা ভাড়া মিটিয়ে একটি পিকআপে উঠে পড়েন। ওই পিকআপে তাঁর মতো আরও ২৫-২৬ জন যাত্রী গাদাগাদি করে করোনার ঝুঁকি নিয়ে তখন রওনা হচ্ছেন।

আকমল হোসেন বলেন, বাড়ি থেকে চন্দ্রা আসতে ভাড়া লেগেছে জনপ্রতি ১ হাজার ৫২০ টাকা। দুজনের খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৪০ টাকা। মাঝে সিরাজগঞ্জের এক হোটেলে দুজনের খাবার খরচ পড়েছে ৩০০ টাকা। স্বাভাবিক সময়ে বীরগঞ্জ থেকে চন্দ্রা আসতে শ্যামলী বা হানিফ পরিবহনে ভাড়া পড়ে ৫৫০ আর নাবিল পরিবহনে ৬৫০ টাকা।

এত টাকা ভাড়া দিয়ে গাজীপুরে ফিরলেন, সমস্যা হবে না? এমন প্রশ্নের জবাবে আকমলের স্ত্রী জুলেখা পারভীন বলেন, ‘টাকা গেছে দুঃখ নাই, কিন্তু হঠাৎ কারখানা খুলে দেওয়ায় চাকরির মায়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়া আসছি। আর কী যে দুর্ভোগ পোহাইতে হইছে, তা বলার মতো না।’

এই সুযোগে পিকআপ ভ্যানগুলোও ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে। এক পিকআপের চালক আব্বাস উদ্দিন জানান, ‘হাজার হাজার মানুষের এখন ট্রাক আর পিকআপই ভরসা। চন্দ্রা ত্রিমোড় থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত জনপ্রতি ২০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তারপরও মানুষের জায়গা দিতে পারছি না। অন্য দিন পুলিশ কিছু বললেও আজ (শনিবার) পুলিশ কিছুই বলছে না।’

শনিবার দুপুরের পর চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ, সবাই শিল্পকারখানার শ্রমিক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকে-পিকআপে তাঁরা ফিরে আসছেন।

চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় আরও অনেকের সঙ্গেই কথা হয়, যাঁদের সবাই ট্রাকে ও পিকআপে করে এসেছেন। বগুড়ার শেরপুর এলাকার বাসিন্দা মো. মোতালেব হোসেন বলেন, তিনি একটি জুতা কারখানায় কাজ করেন। বাড়ি থেকে বের হয়ে একটি ট্রাকে ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় আসেন। এখন বাকি পথ রিকশা দিয়ে যাবেন।

কোনাবাড়ী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর গোলাম ফারুক জানান, শ্রমিকেরা ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন ছোট পরিবহনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরছেন। চন্দ্রা এলাকায় মানুষের মাথা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

শ্রমিকদের কথা হলো, আরও এক দিন আগে ঘোষণা দিয়ে বাস-ট্রেন চালু করে দিলে তাঁরা নির্বিঘ্নে কর্মস্থলে ফিরতে পারতেন। এতে ঝুঁকি নিতে হতো না।