বাংলাদেশ সরকার

সত্যিকারের গরিব লোকজন যাতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা পান, সেটি নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালে ধনী-দরিদ্রের একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এরপর গত আট বছরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে দুজন মন্ত্রী ও পাঁচজন সচিব বিদায় নিয়েছেন, আরেক মন্ত্রীরও দুই বছর পার হয়ে গেছে। অথচ এখনো তালিকাটি প্রকাশ করতে পারছে না সরকার। এতে প্রশ্ন উঠেছে, ধনী–দরিদ্রের তালিকার কী কার্যকারিতা নেই? খরচ হওয়া ৭২৭ কোটি টাকাও কী জলে যাচ্ছে?

করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতিতে গত বছরের মে মাসে সরকার যখন ৫০ লাখ পরিবারের দুই কোটি দরিদ্র মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়, তখন বোঝা গিয়েছিল দেশে ধনী–দরিদ্রের তালিকা কতটা জরুরি। দুই কোটি দরিদ্র মানুষ বাছাই করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় মাঠ প্রশাসনকে। তখন সরকার পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কাছে তালিকাটি চাইলে জানানো হয়, সেটি দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তালিকা না থাকায় ওই টাকা বিতরণে নানা অভিযোগ ওঠে। অনেক সচ্ছল, মানে ধনী ব্যক্তিও টাকা পেয়ে যান। বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা ওঠায় শেষ পর্যন্ত মাঝপথে টাকা বিতরণ বন্ধ করে দেয় সরকার।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সারা দেশে সরকারের এখন ১৪৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। এসব কর্মসূচির ভাতা পাওয়া থেকে বহু গরিব মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন, অথচ অনেক সচ্ছল মানুষ পাচ্ছেন—এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে ভাতা নেওয়া ৪৬ শতাংশ মানুষই তা পাওয়ার উপযুক্ত নন। দেশে ধনী–দরিদ্রের তালিকা না থাকার কারণেই মূলত সামাজিক ভাতা নিয়ে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মত সরকারের নীতিনির্ধারকদের।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে ধনী–দরিদ্রের তালিকা তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৩২৮ কোটি টাকা। তখন পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন এ কে খন্দকার। সাড়ে তিন কোটি খানার ওপর জরিপ চালিয়ে ২০১৭ সালের মধ্যে ধনী–দরিদ্রের চূড়ান্ত তালিকা তৈরির কথা থাকলেও তা হয়নি।

পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত চারবার প্রকল্পটির সময় বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ৩২৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭২৭ কোটি টাকায় ঠেকেছে। প্রকল্পের মেয়াদও বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।

যখন ধনী–দরিদ্রের তালিকা প্রকাশ করা হবে, তখন হয়তো প্রকৃত চিত্র না-ও থাকতে পারে। তবে আমরা চাই তালিকাটা প্রকাশ হোক। তারপর যদি তথ্য হালনাগাদ করতে হয়, তখন করা যাবে।
খালেদ হাসান, যুগ্ম সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ

সমস্যা কোথায়

বিলম্বের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, জরিপের শুরুতেই গলদ ছিল। সাধারণত যেকোনো জরিপ বা শুমারি পরিচালনা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। কিন্তু ধনী–দরিদ্রের তালিকা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগকে, যাদের এই কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। জরিপ কিংবা শুমারি করতে বিরতিহীনভাবে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়, কিন্তু ধনী–দরিদ্রের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে তিন ধাপে। প্রথম ধাপে ২০১৭ সালের এপ্রিলে, দ্বিতীয় ধাপে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ও তৃতীয় ধাপে একই বছর সেপ্টেম্বরে মাঠপর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বিবিএসের কর্মকর্তারা বলেন, মাঠপর্যায় থেকে জরিপের তথ্য সংগ্রহের ছয় মাসের মধ্যে প্রাথমিক ফল ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু ধনী–দরিদ্রের তালিকা তৈরিতে তা করা যায়নি।

জরিপের দায়িত্ব পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগকে দেওয়া হলেও সেই তথ্য সংরক্ষণে সফটওয়্যার তৈরির দায়িত্ব পায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ। দুই সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার এক বড় কারণ।

জানতে চাইলে জাতীয় খানা জরিপ (এনএইচডি) প্রকল্পের পরিচালক তোফায়েল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের তথ্য প্রস্তুত। কিন্তু সফটওয়্যার তৈরির কাজ এখনো শেষ হয়নি। সফটওয়্যারে তথ্য সংরক্ষণের পর সেটি ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।’

সফটওয়্যার তৈরিতে টালবাহানা

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ধনী-দরিদ্রের তালিকা সংরক্ষণে সফটওয়্যার তৈরির কাজটি পেয়েছে আর্মেনিয়ার কোম্পানি সিনার্জি ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেম। ২০১৮ সালে কাজ পেলেও তারা এখনো তা শেষ করতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চুক্তিতে দুর্বলতা ছিল। সেই সুযোগ নিচ্ছে সিনার্জি ইন্টারন্যাশনাল। তারা আর্মেনিয়ায় বসেই সফটওয়্যার তৈরির কাজ করছে। তাদের বারবার বাংলাদেশে আসতে বললেও আসছে না। যত দিন করোনাভাইরাস থাকবে, তত দিন তাদের এখানে পাওয়া যাচ্ছে না, এটা মেনে নিতে হচ্ছে।

যোগাযোগ করা হলে সফটওয়্যার তৈরিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত সচিব সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়েছি বেশি দিন হয়নি। তাই অনেক কিছুই বলতে পারব না। তবে এ বছরের মধ্যেই সফটওয়্যার তৈরির কাজ শেষ করতে পারব বলে আশা করছি।’

কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন

এদিকে তথ্য সংগ্রহের পর দুই বছর পার হয়ে যাওয়ায় খোদ সরকারি নীতিনির্ধারকেরা ওই তথ্যের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সামসুল আরেফিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক ভার্চ্যুয়াল সভায় জানানো হয়, ধনী-দরিদ্রের তালিকা প্রস্তুত হয়ে আছে দুই বছর ধরে। কিন্তু সফটওয়্যার তৈরি না হওয়ায় তা সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না।

ওই সভায় জানানো হয়, প্রক্সি মিনস টেস্টিং (পিএমটি) পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করলে সেটি দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়। ধনী-দরিদ্রের অবস্থা কখনো ভালো আবার কখনো খারাপ হয়। তার মানে, দুই বছর আগের তথ্য আর গ্রহণযোগ্য থাকে না। ফলে এই তথ্য ব্যবহার করে ভালো ফল মিলবে না। কারণ, ইতিমধ্যে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়ে গেছে। সে জন্য সভায় প্রশ্ন ওঠে, এত বছরের পুরোনো তথ্য ২০২২ সালে কতটা কাজে লাগবে?

জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব খালেদ হাসান বলেন, ‘যখন ধনী–দরিদ্রের তালিকা প্রকাশ করা হবে, তখন হয়তো প্রকৃত চিত্র না-ও থাকতে পারে। তবে আমরা চাই, তালিকাটা প্রকাশ হোক। তারপর যদি তথ্য হালনাগাদ করতে হয়, তখন করা যাবে।’