বিশ্বব্যাংকে চাকরি করার সুবাদে সংস্থাটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে প্রায়ই যেতে হতো। ওই কর্মকর্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম, প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে তাঁর মাঝেমাঝে বৈঠক হতো। আবার ব্যক্তিগত পর্যায়েও তাঁর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি আছে। আমাদের প্রথম দেখা হয় ৮০ দশকের শুরুতে। তখন তিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক।
আবুল মাল আবদুল মুহিত সবকিছুতেই আশাবাদী ছিলেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ৮০ দশকের মাঝামাঝি আমি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। তখন তিনি সবে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। ওই সময়ে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে একটি অনানুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন। তখন শ্রোতাদের অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যখন নানা সমস্যা আছে, তখন কীভাবে এগিয়ে যাবে? প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সমস্যা আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। সবাই প্রশ্ন করেছিলেন, এতটা আশাবাদী কেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, দরিদ্র দেশের অর্থনীতিতে আশাবাদী না হলে বাঁচা সম্ভব নয়। আশাবাদী না হলে পরিবর্তন হবে কীভাবে?
পরে আমি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে সলো মডেলের অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখেছি, নিম্ন ও উচ্চ আয়ের মধ্যে ব্যবধান ঘোচানোর বড় হাতিয়ার হলো আশাবাদ। বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের আত্মবিশ্বাস আমি দেখেছি। তিনি মনে করতেন, সমস্যা যতই জটিল হোক না কেন, তা থেকে উত্তরণ সম্ভব।
আবুল মাল আবদুল মুহিতের আরেকটি বড় গুণ ছিল, তিনি যেকোনো বিষয়ে নোট বা প্রতিবেদন দিলে সঙ্গে সঙ্গেই পড়তেন। যেমন কোনো বৈঠকে আমরা কোনো বিষয়ে কয়েক পাতার নোট দিলে তিনি আমাদের সামনেই তার পুরোটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। নোটটি পড়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্বভাবসুলভ প্রাণবন্ত হাসি দিতেন। ওই হাসির অর্থ, নোটের বিষয়বস্তু উড়িয়ে দেওয়া নয়, এর সঙ্গে দ্বিমত নয়। তিনি বিষয়বস্তুর সঙ্গে আরও কিছু যোগ করতেন। আর বড় কোনো প্রতিবেদন দিলে তিনি আমাদের বসিয়ে রেখেই সারসংক্ষেপ পড়তেন। প্রতিটি পাতা উল্টেপাল্টে পড়ে দেখতেন। পরে তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিতেন। তাঁর সঙ্গে বৈঠক করে বের হলে আমাদের মধ্যে একধরনের আস্থা ও আশার সৃষ্টি হতো।
আবুল মাল আবদুল মুহিত খুব গণমাধ্যমবান্ধব ছিলেন। যেমন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের সফরকালে অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সঙ্গে সচিবালয়ে একটি বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু ওই বৈঠকে সাংবাদিকদের অনুষ্ঠানটি কভার করতে দেওয়া হয়নি। তাই তাঁরা চলে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান কভার করতে না দেওয়ার কথা শোনার পর তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। পরে তিনি বিটিভির সাংবাদিকদের ডেকে কথা বলেন। ভিডিও ফুটেজসহ যাবতীয় তথ্য অন্য সাংবাদিকদের দেওয়ার অনুরোধ করেন।
সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা কার্যালয়।