প্লাস্টিকের জগে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছিলেন বকুল বেগম (৬৫)। ‘চাচি, কেমন আছেন?’ জিজ্ঞাসা করতেই বড় একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এরপর বলতে শুরু করলেন, ‘আল্লায় ভালাই রাখছিল বাবা। দোকানটার ওপর ভর করে চলছিলাম। করোনা আইসা সব শেষ কইরা দিল।’
ছোট্ট চায়ের দোকানটি আয়তনে বড়জোর চার ফুট বাই ছয় ফুট। সামনে একটি মাদ্রারাসা ও একটি স্কুল। ঢাকার নিউ ইস্কাটন আবাসিক এলাকার ৩৪ দিলু রোড হচ্ছে দোকানটির ঠিকানা। চায়ের পাশাপাশি চিপস, কলা, রুটি, চকলেট ইত্যাদি আছে দোকানে। প্রতিদিন সকাল সাতটায় দোকান খোলেন বকুল বেগম, বন্ধ করেন রাত ১২টায়।
‘আপনি কি সাংবাদিক?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন বকুল বেগম। ‘হ্যাঁ’ বলতেই শুরু হয় তাঁর কথা বলা, ‘শোনেন, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। লকডাউনের কারণে বন্ধ মানুষের চলাফেরা। বেচাকেনা নাই। আগে যেখানে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিক্রি হতো, এখন হয় ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকার। তা–ও সব দিন দোকান খোলা রাখা যায় না। পুলিশের টহল থাকে।’
দোকানটির সামনে পেতে রাখা টুলে বসেই গত বুধবার কথা হয় বকুল বেগমের সঙ্গে। একসময় দোকানে বসতেন তাঁর স্বামী ইয়াকুব আলী। ১০ বছর আগে হঠাৎ মারা যান তিনি। এরপর থেকে বকুল বেগম নিজেই ধরেন সংসারের হাল। সংসার বলতে তিনি, একটি মেয়ে ও একটি নাতনি। দুই ছেলে বিয়ে করে যে যাঁর মতো সংসার করছেন। একমাত্র মেয়ে বন্যা বেগম। বিয়ে দিয়েছিলেন, একটা বাচ্চাও হলো। নাম আদিবা (৪)। ভাগ্যের পরিহাস, বন্যা বেগমের স্বামীও মারা গেলেন। নিজের জীবন তো আছেই, এখন মেয়ে ও নাতনি—দুজনকেই দেখতে হয় তাঁর।
বকুল বলেন, ‘বয়স তো কম হলো না। সবচেয়ে বিপদে পড়ি তখন, যখন অসুখবিসুখ হয়। শুনবেন আরও?’ দোকানের এক পাশে হেলান দিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছিলেন তিনি। ‘শোনেন, আমার কোনো বাসা নাই। দোকানেই থাকি আমি। এক পাশে মাথা দিলে আরেক পাশে পা দুইটা লম্বালম্বি করে রাখতে পারি না। পা দুইটা ভাঁজ কইরা কুণ্ডলী পাকায়া শুইতে হয়। একটা বাসা নিব, সে উপায় নাই।’ অথচ বিদ্যুৎ বিলসহ এটুকু দোকানঘরের ভাড়াই মাসে পাঁচ হাজার টাকা।
বকুল বেগমের কষ্টের কারণ হয়েছে করোনা। মাঝখানে এক বছর দোকান করতে পারেননি। গ্রামের বাড়িতে মানিকগঞ্জে চলে গিয়েছিলেন। এনজিও থেকে কিছু ঋণ ছিল। কিস্তি জমে গেছে অনেক। এখন কিস্তি নিতে আসছেন না কেউ। কিন্তু দিতে তো হবে। মাথার ওপর চাপটা আছে। তিনি শুনেছেন, তাঁর মতো মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহায্য দিচ্ছেন। তিনি কীভাবে এই সাহায্য পাবেন, তা জানেন না
মুঠোফোন আছে কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘ছিল। নষ্ট হইয়া গেছে। আমার মেয়ের একটা মোবাইল আছে। কারও কাছে চেয়ে প্রতিদিন এক মিনিট করে ওর সঙ্গে কথা বলি। নিজের জীবন তো শেষই। স্বামীহারা আমি স্বামীহারা মেয়েটার কষ্টের কথা চিন্তা করতে করতেই জীবনটা পার করে দিচ্ছি। আল্লায় একদিন আমাদের দিকে চোখ তুইলা তাকাবেন, এই আশায় আছি।’