রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়াই ঢাকার রাজারবাগে আবাসিক এলাকায় একটি ৪০ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের প্রস্তাব অনুমোদন হয়ে গেছে। কিন্তু ওই জায়গায় আদৌ এত উঁচু ভবন নির্মাণ সম্ভব কি না, সেটি সমীক্ষা করে দেখা হয়নি। নেওয়া হয়নি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছ থেকে বাধ্যতামূলক অনুমোদন।
এটি সরকারি সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) খামখেয়ালি করে নেওয়া ২৮৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প। কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই ২০১৬ সালে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর পাঁচ বছরে একটি ইটের গাঁথুনিও পড়েনি। এখন ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গায় সবকিছু নতুন করে সাজাতে হচ্ছে আইসিবিকে। বিশেষ বিবেচনায় ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সংশোধন করে আবাসিক এলাকাকে বাণিজ্যিক এলাকায় রূপান্তর করা হয়েছে। বিস্তারিত সমীক্ষাও করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, সেখানে চারতলা বেসমেন্টসহ ৪০তলা ভবন নির্মাণ সম্ভব নয়। তাই নকশা সংশোধন করে বেসমেন্টসহ এখন ভবনটি ৩২তলা করা হচ্ছে। বেবিচকের অনুমোদনও নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, নতুন নকশায় ভবনটি আটতলা ছোট হলেও প্রকল্প ব্যয় এবারে ১৭ কোটি টাকা বেড়ে ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ছে দুই বছর। এভাবে সব সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকল্পটি পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। সেখান থেকেই মিলবে চূড়ান্ত অনুমোদন। আইসিবি অবশ্য সরকার থেকে টাকা না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ভবনটি তৈরি করতে চায়। সে জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন লাগবে না।
জানতে চাইলে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল হোসেন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যতক্ষণ সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন না পায়, ততক্ষণ কিছু বলা ঠিক হবে না।’
এদিকে প্রকল্পটির পরিচালক প্রকৌশলী আরিফুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, ভবনের ভিত্তি (ফাউন্ডেশন), ঢাকার ডিটেইলস এরিয়া প্ল্যান ও নকশা পরিবর্তনের কারণে এত দিন মূল কাজে হাত দেওয়া যায়
যতক্ষণ সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন না পায়, ততক্ষণ কিছু বলা ঠিক হবে না।আবুল হোসেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আইসিবি
নকশা চূড়ান্ত না করে ও ড্যাপ সংশোধন না করে কীভাবে এত বড় একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়ে গেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পটি আইসিবির নিজস্ব অর্থায়নে নেওয়া। এটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নেওয়া প্রকল্প নয়। এডিপিতে প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়, ততটা নিজস্ব অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পে অনুসরণ করতে হয় না। যে কারণে এখন এসে এসব সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তাঁর মতে, প্রকল্প অনুমোদনের আগেই যদি এসব কাজ করা হতো, তাহলে এখন এমন সমস্যা হতো না।
বিনিয়োগের ক্ষেত্র বাড়ানোর পাশাপাশি পুঁজিবাজারের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ১৯৭৬ সালে আইসিবি প্রতিষ্ঠা করে। রাজধানীর মতিঝিলে বিডিবিএল ভবনে অফিস ভাড়া নিয়ে সংস্থাটি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সে জন্য নিজস্ব একটি স্থায়ী কার্যালয় গড়ে তুলতেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের পাশে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অনুমোদন করে।
এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরিচালক আইনুর আক্তার পান্নাসহ কর্মকর্তারা সরেজমিনে প্রকল্পটি পরিদর্শনে গিয়ে বিস্মিত হন। কারণ, তাঁরা দেখতে পান যে গত পাঁচ বছরে এই প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। এমন বাস্তবতায় আইএমইডির প্রতিবেদনে আইসিবির জন্য ৪০ তলা ভবনটি প্রয়োজন কি না এবং এ ধরনের একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো সক্ষমতাও সংস্থাটির আছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, আইসিবির নিজেদের জন্য একটি বহুতল ভবন হচ্ছে। কিন্তু ভবনটি নির্মাণ হচ্ছে খুবই ধীরগতিতে।
আইসিবির কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, অনুমোদনের পর মাটি পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেছে যে ৪তলা বেসমেন্টসহ ৪০ তলা ভবন করতে গেলে সেখানে সমতল থেকে ১২০ ফুট নিচে পাইলিং করতে হবে। কিন্তু এত নিচে পাইলিং করলে ভবন ঝুঁকিতে পড়বে। এখন নতুন করে সমতল থেকে ৫০ ফুট নিচে পাইলিং করা হবে। সে ক্ষেত্রে ভবনের উচ্চতা কমাতে হবে। ফলে ভবনটি হবে ৩২ তলা।
আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই প্রকল্পের মেয়াদ চলতি অক্টোবর মাসেই শেষ হওয়ার কথা। অথচ এখন পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ১ শতাংশ। যেহেতু জমিটি আইসিবির নিজস্ব, সেহেতু জমি অধিগ্রহণের ঝামেলাও ছিল না। অথচ পাঁচ বছরেও তারা পূর্তকাজ শুরু করতে পারেনি, যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আইএমইডির তথ্য বলছে, ভবনটির কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে পুরো ভবনের নকশা এখনো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে অনুমোদন মেলেনি। রাজারবাগের যে জায়গায় ভবনটি হওয়ার কথা, সেটি ঢাকার ডিটেইল এরিয়া ম্যাপে (ড্যাপ) আছে আবাসিক এলাকা হিসেবে। পরে ড্যাপ সংশোধন করে ওই জায়গাটিকে বাণিজ্যিক এলাকায় রূপান্তর করা হয়। পরিবর্তন আনা হয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডেও। প্রকল্প অনুমোদনের পর নেওয়া হয়েছে ১৩টি সরকারি সংস্থার ছাড়পত্র। অথচ এসব কাজ প্রকল্প অনুমোদনের আগেই করার কথা।