পেঁয়াজচাষিদের এই হাসি এই কান্না
রসুল ইসলামের আট কাঠা জমির বীজতলায় প্রায় ১৫ মণ চারা হয়েছে। এখন চারা তোলার খরচ মেটাতে দরকার ৪ হাজার ২০০ টাকা। বাজারে নিতে লাগবে ভ্যানভাড়া। এর ওপর বিক্রির সময় দিতে হবে খাজনা। অথচ চারাগুলো বিক্রি হবে তিন থেকে চার হাজার টাকা। তাই মনের দুঃখে চারা বিক্রি না করে লাঙল দিয়েই জমি খালি করেছেন তিনি। আর স্ত্রী শারমিন বেগমকে সঙ্গে নিয়ে জমি পরিষ্কার করছেন। গত মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) বিকেলে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের মাঠে এই দৃশ্য দেখা গেছে।
তার আগের দিন সোমবার বাঘা উপজেলার কৃষকদের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। দুই উপজেলার কৃষকেরা বলেন, মাঠে এখন যে পেঁয়াজ আছে, তা বিক্রি করতে গেলে প্রতি বিঘায় প্রায় ২০ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। পেঁয়াজের দাম বাড়লে চাষিরা যেমন হাসেন, তেমনি খরচের টাকা যখন ওঠে না, তখন আবার কাঁদেন। কৃষকেরা জানান, বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ না করা হলে তাঁরা মাঠে মারা যাবেন।
এখন যে পেঁয়াজ উঠছে, তাকে কন্দ পেঁয়াজ বলা হয়। অর্থাৎ বীজ হিসেবে আস্ত পেঁয়াজ জমিতে রোপণ করা হয়েছিল। স্থানীয় চাষিদের ভাষায় এটি মুড়িকাটা পেঁয়াজ। আবার এখন যে পেঁয়াজ জমিতে লাগানো হচ্ছে, সেটাকে চারা পেঁয়াজ বলা হয়। অর্থাৎ বীজ থেকে চারা তৈরি করে সেই চারা লাগানো হচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার এই জেলায় ৫ হাজার ৯৮৭ হেক্টর জমিতে কন্দ পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। আর ১২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে চারা পেঁয়াজ লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে চারা পেঁয়াজ রোপণ করা হয়েছে। বিঘায় কন্দ পেঁয়াজের ফলন হয় ৪০ থেকে ৪২ মণ। এই পেঁয়াজ এখন ৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
দুর্গাপুরের রসুল ইসলাম জানান, তিনি ২ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে বীজ কিনে চারা লাগিয়েছিলেন। তাঁর ১৫ কাঠা জমিতে চারা করতে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু এখন চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হওয়ায় চারা বিক্রি করে খরচ উঠবে না। তাই জমি ভেঙে দিচ্ছেন।
কন্দ পেঁয়াজ চাষিরা জানান, এক বিঘা জমির জন্য বীজ হিসেবে ৮ থেকে ১০ মণ পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে। ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে এই বীজ কিনতে হয়েছে। এর সঙ্গে সার, বিষ ও পরিচর্যা মিলিয়ে বিঘাপ্রতি ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়েছে। অন্যদিকে উৎপাদিত পেঁয়াজ বিক্রি করে কৃষকেরা পাচ্ছেন ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় লোকসান দাঁড়াচ্ছে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। কারণ, মাঠে এখন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে।
গত সোমবার বাঘা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক জানান, তিনি পাঁচ বিঘা জমির পেঁয়াজ এক হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করতে পেরেছেন। দাম পড়ে যাওয়ায় এখন আর পেঁয়াজ তুলতে পারছেন না। কারণ, এক বিঘার পেঁয়াজ তুলতেই পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। তাই দুশ্চিন্তায় আছেন।
একই উপজেলার চর পলাশীফতেপুর গ্রামের চাষি আসাদুল ইসলাম ৫০ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে কন্দ পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে ১৪ বিঘার পেঁয়াজে তাঁর লোকসান হয়নি। বাকি ৩৬ বিঘা জমির পেঁয়াজ নিয়ে চিন্তায় আছেন। কারণ, মাঠে এখন পেঁয়াজের মণ ৬০০-৭০০ টাকায় নেমে এসেছে। এই দামে বিক্রি করলে লোকসান হবে।
আসাদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এখন পেঁয়াজ উঠছে। বিদেশ থাকিও আমদানি হচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী বুলেছিলেন দেশি পেঁয়াজ উঠলে বিদেশ থাইকি আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হবি। কিন্তু একুনো আমদানি হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৃষকের নিজের ট্যাকা থাকলে অন্য ব্যবসা কইরতক। ১০ লাখ টাকা ঋণ করি পেঁয়াজ করিচি। এই ঋণ আমি শোধ করতে পাইরব না। বাইরের পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ না করলে কৃষক মইরি যাবি।’
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করছি, পেঁয়াজের দাম এখনো চাষির উৎপাদন খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে। আপনারা লোকসানের খবর পেলে লিখতে পারেন। আর পেঁয়াজ আমদানির বিষয়টা সরকারের হাতে। সরকার হয়তো আমদানি বন্ধের ঝুঁকি না-ও নিতে পারে। তবে আরেকটা সুখবর হচ্ছে, আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজের যে সংকট তৈরি হয়, সে সময় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ দিয়ে মোকাবিলা করার একটা প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।’ সে ক্ষেত্রে রাজশাহী নেতৃত্ব দেবে বলে তিনি আশা করছেন।