পোশাকের ক্রয়াদেশে ভাটার টান

প্রত্যাশিত ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছে কোনো কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। কয়েক সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

তৈরি পোশাকশিল্প খাত
ছবি: প্রথম আলো

যুক্তরাষ্ট্রের এক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৫ লাখ মার্কিন ডলারের ১০ লাখ টি–শার্ট তৈরির ক্রয়াদেশ পায় নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশন। ঈদের আগে প্রায় পাঁচ লাখ টি–শার্ট জাহাজীকরণের জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। ডিপোর বাইরে ১০ দিন কাভার্ড ভ্যানে সেই পণ্য পড়ে থাকার পর ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বুঝে নেন। বাকি পাঁচ লাখ টি–শার্ট বর্তমানে কারখানায় তৈরি হচ্ছে। তবে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বলেছে উৎপাদন বিলম্ব করতে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে এমবি নিট ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রয়াদেশ পিছিয়ে যাওয়ায় আমাদের পণ্য রপ্তানি হবে নির্ধারিত সময়ের পরে। অর্থও আসবে দেরিতে। আগে থেকে উৎপাদন সূচি নির্ধারিত থাকায় অন্য ক্রয়াদেশের পোশাক তৈরির সুযোগ নেই। এ কারণে কারখানা কিছুটা হলেও আর্থিক সংকটে পড়বে।’

রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার জেরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তাতে সেখানকার বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে পোশাক বিক্রির গতি কিছুটা কমেছে। সে জন্য ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রয়াদেশে লাগাম টানতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে দেওয়া ক্রয়াদেশ পিছিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। প্রতিশ্রুত ক্রয়াদেশও কমিয়ে দিচ্ছে কোনো কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। ফলে জুলাইয়ের পর তৈরি পোশাক রপ্তানি কিছুটা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

করোনার পর বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। গত বছরের শুরু থেকেই ক্রয়াদেশ বাড়তে থাকে। তাতে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রপ্তানি আয় দ্রুত বাড়ে। বাড়তি ক্রয়াদেশ নিতে অনেক কারখানা মালিক উৎপাদনসক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। নিয়োগ দেন বাড়তি শ্রমিক। অবশ্য পর্যাপ্ত শ্রমিক না পেয়ে অনেকেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদনসক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারেননি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৩ হাজার ৫৩৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেশি। ফলে এই অর্থবছর শেষে পোশাকের রপ্তানি আয় ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলারের মাইলফলকে পৌঁছাতে পারে বলে প্রত্যাশা করছেন পোশাকশিল্প মালিকেরা।

ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কেন্দ্রে পোশাক বিক্রির প্রবণতা কিছুটা ধীর। সে কারণে তারা চলমান ক্রয়াদেশের পণ্য জাহাজীকরণ কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে।
মাহমুদ হাসান খান ব্যবস্থাপনা পরিচালক, রাইজিং গ্রুপ

দেশের শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ঢাকার রাইজিং গ্রুপ। গ্রুপটির ছয়টি কারখানা থেকে বছরে ১৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। তাদের কারখানায় আগামী জুলাইয়ে উৎপাদন হবে এমন একাধিক ক্রয়াদেশ দুই সপ্তাহ থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত পিছিয়ে দিয়েছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। সে কারণে ওই মাসে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারবে না গ্রুপটি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বলেন, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কেন্দ্রে পোশাক বিক্রির প্রবণতা কিছুটা ধীর। সে কারণে তারা চলমান ক্রয়াদেশের পণ্য জাহাজীকরণ কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, আগামী আগস্ট পর্যন্ত শীত মৌসুমের পোশাক রপ্তানি হবে। তারপর বসন্ত ও গ্রীষ্মের মৌসুম শুরু হবে। ইতিমধ্যে মৌসুম দুটির পোশাকের ক্রয়াদেশ আসা শুরু করেছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

গত বছরের জুলাই মাসে বিভিন্ন দেশ যখন বিধিনিষেধ থেকে বেরিয়ে আসে। তখন থেকেই মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। তবে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালালে সয়াবিন, গম ও জ্বালানি তেলের মতো নিত্যপণ্যের সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। তাতে মূল্যস্ফীতির সূচক যেন আকাশ ছুঁয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন তিন–চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ ও যুক্তরাজ্যে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। নেদারল্যান্ডস, স্পেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোও স্বস্তিতে নেই।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সেটির প্রভাব পোশাকশিল্পে এখনো পড়েনি। তবে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়লে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ফজলুল হক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্লামি ফ্যাশনস

জানতে চাইলে স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের গ্রুপের কারখানাগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন চালানোর মতো ক্রয়াদেশ রয়েছে। এখনো ক্রয়াদেশ পিছিয়ে দেওয়া বা স্থগিত হওয়ার কোনো ঘটনা নেই। তবে বিদেশি ক্রেতাদের বলতে শুনছি, সামনে বড় ধাক্কা আসতে পারে। যুদ্ধের কারণে ইইউর দেশগুলো সমস্যার মধ্যে আছে। তাই তারা (ক্রেতারা) চিন্তিত।’

বিশ্বজুড়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও করোনা নিয়ন্ত্রণে চীনের বিভিন্ন শহরে লকডাউন থাকায় তৈরি পোশাকের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। জাহাজভাড়া বেড়েছে। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া রাশিয়ায় বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই পোশাকের চাহিদা কিছুটা কমবে বলে মন্তব্য করেন এস এম খালেদ।

ইপিবির তথ্যানুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। তার মধ্যে ইইউতে ৬১ দশমিক ৭৭ শতাংশ রপ্তানি হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে মোট পোশাক রপ্তানির ২১ দশমিক ১৬ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ইইউতে ৫০ শতাংশ ও যুক্তরাজ্যে ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ পোশাক রপ্তানি হয়েছে।

জানতে চাইলে প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, তাঁর কারখানার ১৮ লাখ শর্টস প্যান্টের একটি ক্রয়াদেশ দুই-তিন সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়েছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে ফজলুল হক বলেন, সামগ্রিকভাবে ক্রয়াদেশে কিছুটা ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। গত ছয় মাস পোশাকের ক্রয়াদেশ অস্বাভাবিক ভালো ছিল। কারণ, করোনার পরবর্তী সময়ে বিশাল চাহিদা তৈরি হয়েছিল। সেটিই বর্তমানে স্বাভাবিক অবস্থায় যাবে। তার মানে এই নয় যে আমরা বিপদগ্রস্ত। তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সেটির প্রভাব পোশাকশিল্পে এখনো পড়েনি। তবে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়লে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।