বদলে যাচ্ছে কুরিয়ার সেবার রূপ

গত পাঁচ বছরে অনেক কুরিয়ার কোম্পানি বাজার থেকে হারিয়ে গেছে। আবার অনেক নতুন কোম্পানি এসেছে। প্রবৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও বৈষম্য আছে—বড় কোম্পানি ও ছোট কোম্পানির প্রবৃদ্ধির হার এক নয়।

গত বছর করোনা মহামারির শুরুতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে অনেকেই বাজারে যাওয়া বন্ধ করে দেন। সেই থেকে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যাবে, যাঁরা এখন পর্যন্ত বাজারে যাননি। অনেকে বিশেষ প্রয়োজনে যাওয়া-আসা শুরু করলেও এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনে ফেরেননি। সেই মানুষদের জীবনযাত্রা চলমান রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে ই-কমার্স খাত। ২০২০ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭০ শতাংশ। কর্মসংস্থানের নতুন খাত হয়ে উঠেছে এটি। আর সেই ই-কমার্সের চাকা চলমান রাখতে নীরবে কাজ করে গেছে নতুন ধারার কিছু কুরিয়ার সার্ভিস—ই কুরিয়ার, রেডেক্স, পেপারফ্লাই ইত্যাদি।

কিছু পরিসংখ্যান দিলে এ খাতের প্রবৃদ্ধির চিত্র পরিষ্কার হবে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসংখ্যা ছিল ১১১। আর দেড় বছর পর জুনের হিসাব অনুযায়ী, এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসংখ্যা ১৩৮। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে ২৭টি নতুন কোম্পানি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়েছে। মহামারির আগে দিনে অনলাইন অর্ডারের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার। ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, এখন দিনে অনলাইন অর্ডারের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। আর খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যানুসারে, গত দেড় বছরে প্রথাগত কুরিয়ার সার্ভিসের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে সবার অবস্থা এক নয়।

মহামারি আর কুরিয়ার কোম্পানি রেডেক্স সমবয়সী। গত বছর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে সারা দেশে যখন এক নীরব আতঙ্ক জেঁকে বসেছে, রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কমে গেছে, মানুষ আসন্ন মহামারিতে ঘরে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই বাজারে আসে রেডেক্স। মহামারির সঙ্গেই তার পথচলা। এই দেড় বছরে কেমন অভিজ্ঞতা হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী আফিফ জামান বলেন, বাংলাদেশে ছোট অনেক উদ্যোক্তা আছে, যাদের পক্ষে নিজস্ব লজিস্টিকের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না।

রেডেক্স মূলত সেই উদ্যোক্তাদের সেবা দিচ্ছে। মহামারির শুরুতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেশি ছিল। তখন সিংহভাগ মানুষই ঘরের বাইরে যেত না। ফলে শুরুতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়। সেই চাহিদা মেটাতে রেডেক্স অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ফলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ই-কমার্সের পণ্য সরবরাহের যে বাজার, তার প্রায় অর্ধেকই এখন রেডেক্সের মাধ্যমে হচ্ছে বলে জানান আফিফ জামান। গত মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত তাদের ডেলিভারি বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ শতাংশ, যদিও সবার অবস্থা এক নয়।

মহামারির মধ্যে দেশের অধিকাংশ খাতে যেখানে কর্মসংস্থান কমেছে, সেখানে কুরিয়ার সেবায় কর্মসংস্থান বেড়েছে বলে জানান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এখন নতুন, পুরোনো মিলিয়ে কুরিয়ার সেবায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ কাজ করছেন। চাহিদা বাড়ার কারণেই এটি ঘটেছে। ই কুরিয়ারের প্রধান নির্বাহী বিপ্লব ঘোষ বলেন, সারা দেশে তাঁদের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। অথচ ২০১৭ সালে শুধু ঢাকা শহরেই ই কুরিয়ারের সেবা সীমাবদ্ধ ছিল। দেশব্যাপী এখন এক হাজারের বেশি ডেলিভারি ম্যান কাজ করছেন ই কুরিয়ারের হয়ে। তিনি আরও বলেন, কুরিয়ার সেবায় একটা গুণগত পরিবর্তন এসেছে। এমবিএ করা শিক্ষার্থীরাও এখন এ খাতে কাজ করছেন। ফলে কুরিয়ার নিয়ে এখন অনেক আলোচনা হচ্ছে, আগে যা ছিল না।

ই-কমার্সের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের এ কুরিয়ার সার্ভিস এখন করপোরেটদেরও লজিস্টিক সেবা দিচ্ছে। ই কুরিয়ার এখন ওয়্যারহাউস করার চিন্তা করছে। বিপ্লব ঘোষ বলেন, ‘আপনার পণ্য এখন আপনার কাছেই থাকতে হবে, তা নয়। আমরা তা নিজ দায়িত্বে রেখে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেব।’

কুরিয়ার সেবার সম্ভাবনা অনেক বলেই মনে করেন বিপ্লব ঘোষ। দেশের প্রচলিত সরবরাহ ব৵বস্থায়ও পরিবর্তন আনতে পারে কুরিয়ার। বিপ্লব রহমান বলেন, কুরিয়ারের গাড়িগুলো বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পণ্য পৌঁছে দিয়ে খালি হয়ে ফেরে। অথচ এই খালি গাড়িতে কৃষকের পণ্য সরাসরি বড় শহরের বাজারে নিয়ে আসা সম্ভব। এতে হাত বদলজনিত খরচ কমবে। কৃষক ও গ্রাহক—উভয়ই লাভবান হবেন। ইতিমধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে অনেক কুরিয়ার সার্ভিস বাজার থেকে হারিয়ে গেছে। আবার অনেক নতুন কোম্পানি এসেছে। প্রবৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও বৈষম্য আছে—বড় কোম্পানি ও ছোট কোম্পানির প্রবৃদ্ধির হার এক নয়। তবে সবারই কমবেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ ছাড়া প্রথাগত কুরিয়ার কোম্পানিগুলোও এখন ই-কমার্স ডেলিভারিতে যুক্ত হয়েছে।