বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতেই হবে

করোনাকালে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত। তাঁদের অধিকাংশই মহামারির প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সরকারের প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পাননি। রোগটির সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে লোকসানের আশঙ্কায় আছেন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। এদিকে করোনাকালে চীন থেকে বিদেশি বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হলেও বাংলাদেশ তাদের টানতে পারেনি। সহজে ব্যবসা করার সূচকেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। এসব বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার আবারও লকডাউন জারি করেছে। শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে সরকারের কী উদ্যোগ দরকার—প্রণোদনা নাকি ব্যবসার সুযোগ?

রিজওয়ান রাহমান: দুবাইতে কিন্তু সবকিছু খোলা। আমাদের দেশের বড় ব্যবসায়ীরা ছুটি কাটাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে আপনি মাস্ক ছাড়া ১০ পা–ও এগোতে পারবেন না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আপনাকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুনতে খারাপ শোনাবে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতেই হবে। লকডাউন দিয়ে সব বন্ধ রাখার চেষ্টা করলে সবাই রাস্তায় নেমে পড়বে। কারণ, করোনার ধাক্কায় অধিকাংশ অতিক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী অস্তিত্বসংকটের মুখে আছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নামাতে হবে। আইন ভঙ্গকারীকে জরিমানা করতে হবে। প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের কেউ স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ করলে জরিমানা করে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। আর যদি কোনো কারণে সরকারকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে যথাযথ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশ্ন :

করোনার প্রথম ধাক্কার পর সরকারের দেওয়া প্রণোদনা অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত অতিক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছায়নি। এ বিষয়ে আপনাদের অভিজ্ঞতা কী?

রিজওয়ান রাহমান: করোনার প্রথম ধাক্কার পর গত বছর সরকার প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। প্রণোদনার একটি বড় অংশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেও অতিক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অধিকাংশ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সম্প্রতি ঢাকা চেম্বারের পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মাত্র ৩৪ শতাংশ প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পেতে আবেদন করেছে। বাকি ৬৬ শতাংশ আবেদনই করেনি। আবার আবেদন করা ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ ঋণ পাননি। ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণ পেলেও ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যবসায়ীর আবেদন প্রক্রিয়াধীন। আমাদের জরিপে শুধু ঢাকা শহরের অবস্থা উঠে এসেছে। এই চিত্র থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, মফস্বল শহর বা গ্রামের ব্যবসায়ীদের অবস্থা কতটা খারাপ হতে পারে।

প্রশ্ন :

কেন ছোটরা সরকারের প্রণোদনার ঋণ পেলেন না?

রিজওয়ান রাহমান: করোনার প্রথম ধাক্কার পরপরই রপ্তানি খাতের দিকে তাকিয়ে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এবার স্থানীয় ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে প্রণোদনা লাগবে। কারণ, তারাই বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) তথ্যানুযায়ী, দেশে ১০ জনের মধ্যে ৭ জনের কর্মসংস্থানের পেছনে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অবদান রয়েছে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ৬২ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ৩৮ শতাংশ এক বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ, ছোটদের ঋণ দেওয়ার বিষয়ে ব্যাংকের আগ্রহ কম। প্রতিটি ব্যাংকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপকের ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে। সেই লক্ষ্য পূরণে ব্যাংকাররা বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণেই বেশি মনোযোগ দেন। সে জন্য ছোটদের ঋণ বিতরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনা দরকার হলেও সেটি করা হয়নি। তা ছাড়া জামানত দিয়ে ঋণ দেওয়ার মতো বিলাসী অবস্থানে এখনো পৌঁছাতে পারিনি আমরা। অধিকাংশ ব্যবসায়ীকে ব্যাংকিং চ্যানেলেও আনা যায়নি। তাই জামানতবিহীন ঋণের ব্যবস্থা না করলে ছোট উদ্যোক্তাদের কাছে সহায়তা পৌঁছানো যাবে না।

প্রশ্ন :

করোনার কারণে গত এক বছরের ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেল বড় ব্যবসায়ীরাই সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। সরকার চাইলেও ছোট ব্যবসায়ীদের কোনো সহযোগিতা করতে পারছে না। এই জায়গায় কীভাবে উন্নতি করা যায়?

রিজওয়ান রাহমান: দেখুন, শুধু ব্যবসা নয়। প্রকৃতিতেও লক্ষ করবেন বড়দের সামর্থ্য বেশি। বড়দের টিকে থাকার সামর্থ্য ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সহজেই লাভ করতে পারে। অপর দিকে ছোট ব্যবসায়ীরা দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। ছোটদের সহযোগিতা করতে হলে দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। কোন খাতের কত অবদান, সে অনুযায়ী প্রণোদনা বণ্টন হওয়া প্রয়োজন। ১০০ টাকা প্রণোদনা দেওয়া হলে ৮০ টাকাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পাওয়া উচিত। কারণ, অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অবদান প্রায় ৮২ শতাংশ। তাহলেই কেউ প্রশ্ন করবে না।

প্রশ্ন :

করোনায় বিশ্ব অর্থনীতি ওলটপালট হয়ে গেছে। এক দেশের বিনিয়োগ অন্য দেশে চলে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা কোথায় ছিল?

রিজওয়ান রাহমান: শুধু করোনার কারণে নয়, বিশ্বায়নের এই যুগে বিনিয়োগ কোনো দেশে স্থায়ী হবে না। যেখানেই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ রয়েছে, বিনিয়োগ সেখানেই চলে যাবে বা আসবে। করোনার শুরুতে নিজেদের অনেক প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দিয়ে চীন থেকে সরিয়ে এনেছে জাপান। তবে সহজে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের করপোরেট কর অনেক বেশি। ভারতে নতুন কোম্পানির জন্য করপোরেট কর ১৫ শতাংশ, আর পুরোনো কোম্পানির জন্য ২০ শতাংশ। তাহলে আপনি কী সুবিধা দিলেন যে বিদেশি বিনিয়োগ চলে আসবে? আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোথাও বিনিয়োগের আগে সে দেশের ব্যবসায়ীদের অবস্থা জানতে চায়। সে জন্য দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আগে শক্তিশালী করতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ব্যবসা সহজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উদ্যোগ নিয়েও খুব দ্রুত এগোতে পারছে না। বর্তমানে কোথায় কোথায় সমস্যা?

রিজওয়ান রাহমান: প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পর সহজে ব্যবসা করার সূচকে ৮ ধাপ এগিয়েছি। চলতি বছর করোনার কারণে র‌্যাঙ্কিং করেনি বিশ্বব্যাংক। তারপরও বলব, অনেক দেশের চেয়ে ভালো করছি আমরা। দ্রুত এগোতে হলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) শক্তিশালী করতে হবে, যাতে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে। তা ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইনি সংস্কার দরকার। কারণ, করপোরেট মামলা নিষ্পত্তি হতে ৮-১০ বছর লেগে যায়। ইতিমধ্যে আইন সংশোধন করে এক ব্যক্তির কোম্পানি খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে পরিশোধিত মূলধন ২৫ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে আনতে হবে।