ডলার–সংকট
বিলাসপণ্য আমদানি নিষিদ্ধের পথে কি হাঁটবে বাংলাদেশ
রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে আমদানি ব্যয় মিটছে না। ফলে প্রতি মাসে ঘাটতি হচ্ছে ১০০ কোটি ডলার।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য, মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামালের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে জাহাজভাড়াও। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) আমদানি খরচ বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। তবে খরচ যে হারে বেড়েছে, রপ্তানি সে হারে বাড়েনি; বরং প্রবাসী আয় কমছে। আয় দিয়ে ব্যয় মিটছে না। প্রতি মাসে ঘাটতি হচ্ছে ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে আছে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ। এসব সংকটে বাড়ছে ডলারের দাম, আর চাহিদা মেটাতে গিয়ে কমছে রিজার্ভ।
এমন পরিস্থিতিতে কী করতে পারে বাংলাদেশ, এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। চাইলেই রাতারাতি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। আবার ডলারের দাম বাড়ালে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তাও নেই। আবার ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত দরের চেয়ে ১০ টাকা বেশি দরে আমদানিকারকদের পণ্য আমদানির দায় শোধ করতে হচ্ছে। ফলে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে আমদানি খরচে লাগাম টানতে হবে। পাশাপাশি প্রবাসী আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য প্রবাসী আয়ে সাময়িক সময়ের জন্য প্রণোদনা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ। সেই সঙ্গে রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন জোরদার করারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বিলাসবহুল গাড়ি ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানিতে ৭০ শতাংশ নগদ জমার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফর বন্ধ করেছে সরকার।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২০ সালে ব্যক্তিগত গাড়ি নিবন্ধন হয়েছিল ১২ হাজার ৪০৩টি, ২০২১ সালে ১৬ হাজার ৪৯টি। আর চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) নিবন্ধন হয়েছে ৬ হাজার ৫৭৭টি। আর ২০২০ সালে মাইক্রোবাস নিবন্ধন হয়েছে ২ হাজার ৭৭৯টি, ২০২১ সালে ৪ হাজার ৯৪১টি ও চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ২ হাজার ৮২৮টি। ২০২০ সালে বিলাসবহুল জিপ নিবন্ধন হয়েছে ৪ হাজার ৯১১টি, ২০২১ সালে যা বেড়ে হয় ৭ হাজার ৬০২টি; আর চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৩ হাজার ৭২৪টি।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার হিসাবে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত দেশে গাড়ি আমদানি হয়নি। এরপর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব মিলিয়ে ২৩ হাজার ২১৮টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। পুরোনো গাড়ির পাশাপাশি দামি নতুন গাড়িও এসেছে এ সময়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে গাড়ি আমদানিতে খরচ হয়েছিল ৯ হাজার ৭০১ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে যা বেড়ে হয় ১১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।
এর মধ্যে ডলার–সংকট সামাল দিতে গাড়ি, মুঠোফোন, সিগারেটসহ ৩৮ পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করেছে পাকিস্তান। দেশটিতে ডলারের বিনিময় মূল্য এরই মধ্যে ২০০ রুপি ছাড়িয়েছে। এ কারণে সংকট সামাল দিতে বিলাসপণ্য আমদানি নিষিদ্ধের পথ বেছে নিয়েছে পাকিস্তান। বাংলাদেশেও সাময়িক সময়ের জন্য বিলাসপণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার বা বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আমদানির চাপ কমাতে এই পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য বিলাসপণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা বন্ধ করে দিতে হবে। যেসব ঋণপত্র খোলা হয়েছে, তা–ও বাতিল করতে হবে। যেসব খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, আপাতত সেসব পণ্য আমদানি বন্ধ করা যেতে পারে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, আয় বাড়াতে সাময়িক সময়ের জন্য প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা বাড়ানো যেতে পারে। পোশাকের যে রপ্তানি আয় আটকে আছে, তার প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে। এতে আয় বাড়বে। আর খোলাবাজারে ডলারের দাম এত বাড়ল কেন, তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা খতিয়ে দেখতে পারে। কেউ বেশি মুনাফার আশায় মজুত করছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখতে হবে। মানি চেঞ্জারগুলোতে ডলারের দামের পার্থক্য যাতে সর্বোচ্চ ২-৩ টাকা বেশি হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এখন প্রবাসী আয়ে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ডলারের দাম ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা হলেও খোলা বাজারে যা ৯৬-৯৭ টাকা। ফলে প্রবাসী আয় অবৈধ পথে আসছে। এর বিপরীতে বাড়বে অর্থ পাচার। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো ৯৪-৯৫ টাকা দরে রপ্তানি বিল নগদায়ন করছে, এই দামে প্রবাসী আয়ও আনছে।
জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার ও অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে সাময়িক সময়ের জন্য গাড়ি ও বিলাসপণ্য আমদানি বন্ধ করলে ও প্রবাসী আয়ে ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিলে ডলারের সংকট কেটে যাবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও ডলার ছাড় করতে হবে, তাহলে আতঙ্ক কেটে যাবে।’
বর্তমানে ডলারের সংকট চলছে, তা চলতে থাকলে বছর শেষে রিজার্ভ তিন হাজার কোটি ডলারে নেমে আসবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার। তবে এই রিজার্ভ থেকে রপ্তানিকারকদের ঋণ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার, শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার, পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতে দেওয়া হয়েছে ৬০ কোটি ডলার। এ ছাড়া কিছু ডলার সোনালী ব্যাংকে রাখা হয়েছে, আরও কিছু দিয়ে তহবিল গঠন করা হয়েছে। ফলে রিজার্ভের ৮০০ কোটি ডলার ইতিমধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অতি সাবধানতার বিকল্প নেই বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এ জন্য তাঁরা প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বিল নগদায়নে ডলারের সীমা বেঁধে দেওয়া এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। আর ডলারের দাম যাচাইয়ে মাঠে নেমেছেন কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সময় দেশের বাইরে বিনিয়োগ একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আয় বাড়াতে ও খরচ কমাতে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নিতে হবে।’