ভারতের অনড় অবস্থান উত্তেজনা বাড়িয়ে দিল

বালিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
বালিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

মূলত ভারতীয় কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) প্রতিনিধিরা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সম্মেলন উদ্বোধনের (মঙ্গলবার) পর সম্মেলন প্রাঙ্গণে কয়েক মিনিটের জন্য বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশসহ গুটি কয়েক দেশের আরও কয়েকজন। আর এই প্রতিবাদে দাবি তোলা হয়, খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কোনো ছাড় না দেওয়ার।

আজ বুধবার সকালে প্লিনারি অধিবেশনে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করেন যে খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে কৃষিতে ভর্তুকি প্রথা পুনর্বিন্যাসের জন্য নিজ অবস্থান থেকে ভারত নড়বে না। শর্মা এও জানিয়ে দেন প্রস্তাবিত বাণিজ্য সহজীকরণ (ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন) প্রস্তাবও তাদের কাছে গ্রহণযোগ নয়।

এর মধ্য দিয়ে বালি সম্মেলনের পরিণতিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়ার দায় এখন ভারতের ওপর গিয়েই পড়েছে। যদিও ভারতের এ অবস্থানের প্রতি সমর্থন রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের।

দিনের প্রথম ভাগে ভারতের এই অনড় অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হওয়ার পর সম্মেলনে যেন বড় ধরনের উত্তেজনা খুঁজে পাওয়া গেল। কেউ কেউ রসিকতা করে এমন মন্তব্যও করেছেন যে উত্তেজনাহীনভাবে ডব্লিউটিওর সম্মেলন চলতে পারে না। কাজেই এটা খুব প্রয়োজন ছিল।

ভারতের অনড় অবস্থান প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাটস ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব প্রদীপ মেহতা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই সম্মেলনে ভারতকে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা চলছে। অথচ খাদ্যনিরাপত্তা তথা কৃষি ভর্তুকি উন্নয়ন দেশগুলোর গরিব কৃষকদের জন্য স্পর্শকাতর একটি বিষয়।’

ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ প্রদেশ বালির নাসু দুয়া আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে (বিএনডিসিসি) গতকাল মঙ্গলবার থেকে ডব্লিউটিওর নবম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন শুরু হয়েছে। এবারের সম্মেলনে মূলত তিনটি বিষয়ে একটি মতৈক্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে বালি প্যাকেজ চূড়ান্ত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এগুলো হলো বাণিজ্য সহজীকরণ, খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কৃষি ভর্তুকি ও এলডিসিগুলোর সুবিধা। অবশ্য প্রথম দিনই স্পষ্ট আভাস পাওয়া গিয়েছিল যে বাণিজ্য সহজীকরণ ও কৃষি ভর্তুকি নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বড় ধরনের বিরোধে জড়িয়ে পড়বে।

সম্মেলনস্থলে কথা হয় নয়াদিল্লিভিত্তিক একাডেমি অব বিজনেস স্টাডিজের পরিচালক অরুন গয়ালের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘ভারত যে খাদ্যনিরাপত্তা আইন পাস করেছে, তার মাধ্যমে দেশটির কোটি কোটি গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য বিতরণ করতে পারবে। তবে এর জন্য কৃষি ভর্তুকি এতটা বাড়াতে হবে যে তা ডব্লিউটিওর নির্ধারিত ১০ শতাংশ সীমা ছাড়িয়ে যাবে। আবার বড় ধরনের খাদ্য মজুত গড়ে তোলার পর ভারত যদি স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পর বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করতে যায়, তাহলে তা কম দামে করতে পারবে। এসব কারণ দেখিয়ে উন্নত দেশগুলো ভারতের চাওয়া মেনে নিতে নারাজ। কিন্তু তারা বছরের পর বছর বিশ্ব বাজারে কম দামে খাদ্য ছেড়েছে।’

অরুন গয়াল আরও বলেন, ভারত চায় কৃষি ভর্তুকির বিষয়ে একটি স্থায়ী সমাধান, চার বছরের জন্য ছাড়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি এখন আর মানতে চাচ্ছে না।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তথা উন্নত বিশ্ব বলছে, বাণিজ্য সহজীকরণ প্রক্রিয়ায় তারা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সহযোগিতা দিতে রাজি আছে। তারই প্রমাণ দিতে সম্মেলনের প্রথম দিন সু্ইডেন ঘোষণা দেয় যে তারা তানজানিয়ায় ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৬০ কোটি ডলার অনুদান দেবে।

আর আজ এক সংবাদ সম্মেলনে ইইউ ট্রেড কমিশনার কারলে গুচ বলেন, বাণিজ্য সহজীকরণের বিষয়টি উন্নত দেশের চেয়ে উন্নয়শীল ও এলডিসিগুলোর জন্যই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

তবে বাণিজ্য সহজীকরণবিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউটিও সচিবালয়ের জোসেফ বোশ বলেন, বাণিজ্য সহজীকরণের বেশ কিছু ক্ষেত্রে মতবিরোধ রয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে আছে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া ও কনসুলার মাশুল। আবার সদস্য অনেক দেশ বাজার উন্মুক্তকরণ ও কারিগরি সহায়তাপ্রাপ্তিকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দিয়েছে।

জোসেফ জানান, বাণিজ্য সহজীকরণ বিষয়ে সমঝোতা হলে তা উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্য ব্যয় অন্তত ১০ শতাংশ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্য ব্যয় অন্তত ১৫ শতাংশ কমাবে।

মোটা দাগে বাণিজ্য সহজীরণ হলো আমদানি-রপ্তানির দলিলপত্রসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া দ্রুততর ও সহজ করা যেন সময় ও খরচ কম হয়। একই সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নের কথাও বলা হয়েছে।

এদিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আজ দুপুরেও সম্মেলনকেন্দ্রের ভেতর কিছুক্ষণের জন্য বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়ে স্লোগান দেন।