ভোজ্যতেলের জোগান নিয়ে দুশ্চিন্তা

ভোজ্যতেল আমদানি কমেছে। আবার আর্জেন্টিনা রপ্তানি সীমিত করেছে ও ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।

ভোজ্যতেল নিয়ে একের পর এক দুঃসংবাদ আসছে। গত মার্চে আর্জেন্টিনা সয়াবিন রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছিল। এর দেড় মাসেরও কম সময়ে গত শুক্রবার ইন্দোনেশিয়া পামতেল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এতে দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে।

ভোজ্যতেলের মধ্যে পামতেলের সরবরাহ নিয়ে এ মুহূর্তে দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি। কারণ, বাংলাদেশে পামতেলের ৯০ শতাংশই আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। এই তেল রপ্তানিতে ইন্দোনেশিয়ার বিকল্প দেশের সংখ্যাও হাতে গোনা। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশে সয়াবিন ও পামতেল—দুটোরই আমদানি কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। এই দুটি দেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে সূর্যমুখী তেল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় চাপ পড়ে সয়াবিন ও পামতেলের ওপর। তাতে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে গত ১১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পণ্য লেনদেনের বাজার শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে সয়াবিনের দামে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। সেই রেকর্ডও ভেঙে গত শুক্রবার দাম টনপ্রতি ১ হাজার ৮৩৫ ডলারে গিয়ে ঠেকে। ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর পামতেলের দামও এখন বাড়ছে।

আমদানিকারকেরা বলছেন, এখন বিশ্ববাজার থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানিতে টনপ্রতি ২ হাজার ডলার খরচ পড়বে। পামতেল আমদানিতে এ খরচ দাঁড়াবে ১ হাজার ৭৫০ ডলার। আর দেশে এ মাসে টনপ্রতি সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮৭০ ডলারে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। পামতেল আমদানি হয়েছে সর্বোচ্চ দেড় হাজার ডলারে।

মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বিশ্ববাজার এখন খুব অস্থির। কাল কী হবে, তা বলা যাচ্ছে না। ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পর আমদানির জন্য সরবরাহকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। তাঁরা পরিস্থিতি দেখার কথা বলছেন। ইন্দোনেশিয়া সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পর বিশ্ববাজারের পরিস্থিতি বোঝা যাবে।’

বিকল্প দেশ এখন মালয়েশিয়া

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো নিজ দেশের বাজারসহনীয় রাখতে গত শুক্রবার পামতেল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেন, যা কার্যকর হবে ২৮ এপ্রিল থেকে। এদিকে সিদ্ধান্তটি কার্যকর হলে আগে যেসব ঋণপত্র খোলা হয়েছে সেসব পণ্য সরবরাহ হবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে পামতেল রপ্তানির প্রায় ৫৬ শতাংশই করে ইন্দোনেশিয়া। গত মৌসুমে দেশটি রপ্তানি করে ২ কোটি ৬৮ লাখ টন। একই মৌসুমে প্রায় ৩৩ শতাংশ রপ্তানি করেছে মালয়েশিয়া, যা পরিমাণে ১ কোটি ৫৮ লাখ টন। এর বাইরে গুয়াতেমালা, কলম্বিয়া, পাপুয়া নিউগিনি রপ্তানি করলেও পরিমাণটা খুবই কম, ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টন।

বাংলাদেশের জন্য পামতেল আমদানির বিকল্প হিসেবে আছে মালয়েশিয়া। বর্তমানে পামতেলের ১০ শতাংশ আমদানি হয় দেশটি থেকে। সমস্যা হচ্ছে, শুধু বাংলাদেশই নয়, ভারত, চীন, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্তত ৫৯টি দেশ (যারা বছরে ১ লাখ টনের বেশি আমদানি করে) এখন মালয়েশিয়ার দিকে ঝুঁকবে। তাই ইন্দোনেশিয়া বাজার না খুললে মালয়েশিয়ার পক্ষে এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়।

সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত পণ্যবাজার বিশ্লেষক আসির হক অবশ্য মনে করেন, ইন্দোনেশিয়া নিষেধাজ্ঞা দিলেও বেশি দিন ধরে রাখতে পারবে না। কারণ, দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম খাত হলো পামতেল রপ্তানি। তবে তাদের ওই সিদ্ধান্তে ভোক্তা দেশগুলোকে চড়া মূল্যে ভোজ্যতেল কিনতে হবে। কারণ, শীর্ষ আমদানিকারক দেশ ভারত ও চীন এখন মালয়েশিয়ার দিকে ঝুঁকবে। তাতে দাম বাড়বে।

যেসব খাতে প্রভাব পড়বে

পামতেল সরবরাহে সংকট হলে বেশি প্রভাব পড়বে হোটেল–রেস্তোরাঁ ও খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলোর ওপর। কারণ এ দুটি খাতেই পামতেলের ব্যবহার বেশি হয়।

ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার প্রভাবে সয়াবিনের দামও বিশ্ববাজারে বাড়ছে। দেশে গৃহস্থালিতে রান্নায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় সয়াবিন তেল। সয়াবিন আমদানির সিংহভাগই বোতলজাত আকারে বিক্রি হয়। গত মার্চে আর্জেন্টিনা রপ্তানি সীমিত করলেও দেশটি থেকে সয়াবিন আমদানি হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এখন অবশ্য তিন জাহাজ থেকে খালাসের অপেক্ষায় আছে ৪৫ হাজার টন সয়াবিন।

আমদানি কমিয়েছে কোম্পানিগুলো

বিশ্ববাজারে অস্থির হওয়ার পর থেকে প্রধান দুই ভোজ্যতেলের আমদানি কমছে। আমদানি কমানোর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের যুক্তি, সরকার পাম ও সয়াবিন তেলের যে দর বেঁধে দিয়েছে, তার চেয়ে আমদানি মূল্য এখন বেশি পড়ছে। তাই তাঁরা আমদানি কমিয়েছেন। অর্থাৎ অল্প অল্প করে আমদানি করছেন।

দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সয়াবিন ও পামতেল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৫২ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল প্রায় ৬ লাখ টন।

সামনে কী হবে?

ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত ২৮ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ার আগেই বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বাজার না খুললে সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে। কারণ, বাংলাদেশে প্রধান দুটি ভোজ্যতেল সয়াবিন ও পামতেলের চাহিদা পূরণ হয় শতভাগ আমদানির মাধ্যমে।

এ পরিস্থিতিতে করণীয় প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তা তৈরি করবে। এ সময় সরবরাহ যাতে ঠিক থাকে, সে জন্য ব্যবসায়ীদের আমদানিতে উৎসাহ দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে মূল্য সমন্বয় করতে হতে পারে। আবার সরকারও আমদানি করে বাজারে সরবরাহ বাড়াতে পারে।