মাছবাজারে কমে গেছে ক্রেতা
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামাল দিতে নানাভাবে সংসার খরচ কাটছাঁট করছেন নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরাও। আর মধ্যবিত্তরা মাছ–মাংস কেনায় কিছুটা হিসাবি হয়ে উঠেছেন। এতে মাছের বাজারে কমে গেছে ক্রেতা। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শেওড়াপাড়া, হাতিরপুল, কারওয়ান বাজার, কাঁঠালবাগান বাজার ঘুরে ও মাছ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
আগে থেকেই মাছের দাম নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বাজারে কম দামি মাছ বলতে একমাত্র তেলাপিয়া। তাই যেটুকু মাছ এখন বিক্রি হচ্ছে, তার বড় অংশই তেলাপিয়া। রাজধানীর বাজার ও মানভেদে তেলাপিয়া মাছের কেজি ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। মাছের বাজারে ২০০ টাকার কমে এ মাছই পাওয়া যাচ্ছে এখন। এরপরই আছে রুই আর কই মাছ। রাজধানীর বাজার ও আকারভেদে রুই মাছের কেজি ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা। বেশির ভাগ বাজারে যেসব রুই মাছ পাওয়া যায়, সেগুলোর ওজন দেড় কেজির বেশি। ফলে রুই মাছ কেনার সামর্থ্য অনেকের নেই।
মাছ বিক্রেতাদের দাবি, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ঈদের পর যতটা বেড়েছে, মাছের দাম সেভাবে বাড়েনি। তারপরও ক্রেতা কম। বিক্রেতারা বললেন, বেশির ভাগ ক্রেতাই এসে দাম জিজ্ঞেস করে চলে যান।
শেওড়াপাড়া বাজারে গতকাল সকালে এই প্রতিবেদক এক মাছ বিক্রেতার কাছে দরদাম জিজ্ঞেস করতেই কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি জানতে চান, ‘কিনবেন, নাকি শুধু দাম শুনতে আসছেন। সবাই এসে শুধু দাম জিজ্ঞেস করে চলে যায়।’
সেখানে মাছের বাজারে ৩০ মিনিটের বেশি সময় অপেক্ষা করে দুজন ক্রেতার দেখা মেলে। এর মধ্যে একজন ক্রেতা ইলিশ মাছের দাম শুনে বেরিয়ে যান। আরেকজন ক্রেতা ২৮০ টাকায় এক কেজি কই মাছ কেনেন। এক কেজি মাছ কেনায় বিক্রেতা খুশি হয়ে তাঁর কাছ থেকে কাটার পয়সা রাখেননি।
দুপুরে জুমার নামাজের পরে হাতিরপুলের মাছবাজারে গিয়েও দেখা যায় ক্রেতা নেই। এই প্রতিবেদক ওই বাজারে ঢুকতেই শুরু হয়ে যায় হাঁকডাক, ‘ভাই আসেন, দাম কমায় রাখমু’। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে জানা গেল, এ বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে তেলাপিয়া মাছ। সেলিমউল্লাহ নামের এক বিক্রেতা জানালেন, প্রতি কেজি তেলাপিয়া মাছ বিক্রি করেছেন ১৮০ টাকায়। এই প্রতিবেদক জানতে চান, কেজিতে কয়টা মাছ ধরে। বললেন, তিনটি মাছে এক কেজির কিছুটা বেশি হয়। প্রতিটি মাছকে খুব হিসাব করে টুকরা করলেও মাথা, লেজসহ তিন টুকরার বেশি হবে না। তাতে ৩টি মাছে টুকরা হবে ৯টি। পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে ১৮০ টাকার মাছে দুই বেলাও যাবে না।
বাজার খরচ বাঁচাতে অনেকেই মাছ, মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এমন একজন রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর এলাকার বাসিন্দা সোহানা আক্তার। গৃহিণী সোহানার স্বামী শামসুল হক একটি পোশাক কারখানার মান যাচাইকারী কর্মী। ওভার টাইমসহ সব মিলিয়ে মাসে বেতন ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। এ টাকায় বাসাভাড়া, সন্তানের পড়ার খরচ, বাজার খরচ মিলিয়ে কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছেন না তাঁরা। সোহানা বলেন, ‘বাজার খরচ কিছুটা বাঁচাতে মাছ–মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি এখন।’
ভোজনরসিক বাঙালির চিরায়ত প্রবাদ, ‘মাছে–ভাতে বাঙালি’। সেই বাঙালির একটি শ্রেণির কাছে মাছ খাওয়াও এখন অনেকটা বিলাসিতা। আর মাছ খাওয়াকে বিলাসিতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে ‘দাম’। রাজধানীর বাজারভেদে প্রতি কেজি রুই মাছের দাম ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা, কাতলা মাছ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, পাবদা আকারভেদে ৩৮০ থেকে ৬০০ টাকা, বাইলা মাছ মানভেদে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, ইলিশ আকারভেদে ৭৫০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা কেজি।
আর ছোট মাছের দাম আরও বেশি। মলা মাছ বাজারভেদে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, পুঁটি ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা। আর গরিবের মাছখ্যাত পাঙাশের কেজিও ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। যেসব পাঙাশের দাম একটু কম, সেগুলো আবার আকারে বেশ বড়। তাতে কয়েক কেজি ওজনের একটি পাঙাশ কিনতে হলে পকেট থেকে বেরিয়ে যাবে ৫০০ থেকে হাজার টাকা।
তাহলে মাছ খাওয়ার উপায় কী সীমিত আয়ের মানুষের। একটি উপায় হতে পারে, যদি মাছ টুকরা হিসেবে বিক্রি শুরু হয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে মাছ টুকরা হিসেবে বিক্রি হলেও বাংলাদেশে এখনো সেই প্রচলন শুরু হয়নি। তবে পরিস্থিতি বলছে, এ ব্যবস্থা থাকলে হয়তো সীমিত আয়ের মানুষেরা কিছুটা হলেও মাছ খাওয়ার সুযোগ পেতেন।