যান্ত্রিকীকরণে বদলে যাচ্ছে কৃষকের জীবন

কম্বাইন্ড হারভেস্টরের মাধ্যমে মাড়াইয়ের পর জমির ধারে ধান সাজিয়ে রাখা হচ্ছে
ছবি: মেটালের সৌজন্যে

মাটি চাষে লাঙল ও গরুর ব্যবহার প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ফসল রোপণ, কাটা ও তোলার জন্য যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। ফলে কৃষি উৎপাদনে শ্রমিকের যে সংকট রয়েছে, তা অনেকটা কেটে যাচ্ছে। আর যন্ত্রের ব্যবহারে খরচ কম হওয়ায় কৃষকও ধান উৎপাদন করে ভালো দাম পাচ্ছেন। উৎপাদিত ধান নষ্টও হচ্ছে না।

পাশাপাশি কৃষির একেকটি যন্ত্র একজন কৃষককে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছে। যন্ত্র চালাতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যা বদলে দিচ্ছে কৃষকের জীবন। দেশের কৃষকের কাছে যন্ত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজটি শুরু হয় মেটালের হাত ধরে, সেই ১৯৯৩ সালে। এখনো যা চলছে বড় পরিসরে।

কৃষিযন্ত্র কিনতে এখন সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে। এ সুবিধা চলবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। আবার সরকারি ভর্তুকির ৭০ শতাংশ যাচ্ছে হাওর ও উপকূল এলাকায়। ফলে সব এলাকার কৃষকের মধ্যে যন্ত্র কেনায় আগ্রহ বাড়ছে। কৃষকদের পাশাপাশি এখন অনেক তরুণ গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। একটি যন্ত্র দিয়েই একজন উদ্যোক্তা গড়ে উঠছে। ধান রোপণ ও কাটার যন্ত্র কিনে এভাবে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার কৃষি খাতের উদ্যোক্তা। পাশাপাশি গ্রামে শিক্ষিত ব্যক্তিদের কাজের ক্ষেত্রও বেড়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে খরচ কমে ও বেড়ে যায় উৎপাদন। পাশাপাশি কায়িক শ্রমও অনেক কমে আসে। এখন কৃষিশ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এক জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন করতে চাইলে যন্ত্র ব্যবহারের বিকল্প নেই। কৃষিযন্ত্রের মাধ্যমে কৃষকের জীবন–মানে বড় পরিবর্তন আসছে।

কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিকাজে ৯৭ শতাংশ জমি প্রস্তুত হচ্ছে যন্ত্রের মাধ্যমে। আর ধান রোপণ ও কাটায় মাত্র ৩ শতাংশ যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। এই কারণে সরকারও কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে চাইছে। এ জন্য দিচ্ছে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি। আর ট্যাফে ও আইশার ব্রান্ডের কৃষিযন্ত্র কিনতে মেটাল কৃষক পর্যায়ে ঋণ দিচ্ছে। পাশাপাশি যন্ত্র ব্যবহারে সচেতনতা গড়ে তুলছে, দিচ্ছে প্রশিক্ষণও।

মেটাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সহায়তায় ২০১৮-১৯ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে যন্ত্রের চালক, কৃষক, বীজ ডিলার ও বীজ প্রস্তুতে যুক্ত নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১ হাজার ৭৬৭ জন। প্রশিক্ষণ পেয়েছেন যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, কক্সবাজার, রাজবাড়ী এলাকার কৃষক, চালক ও উদ্যোক্তারা।

মূলত ধান রোপণ ও কাটার যন্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ ভ্যান দিয়ে মেরামত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যখন যেখানে যন্ত্রে সমস্যা হচ্ছে, ভ্যান ছুটে যাচ্ছে সেখানে। ফলে এসব যন্ত্র বেশির ভাগ সময় কার্যকর থাকছে। আর যন্ত্রের আয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছে একেকটি পরিবার।

ঝিনাইদহের আশরাফ মহাজন গত মার্চে মেটাল থেকে ধানকাটা যন্ত্র কিনেছেন। সরকারি ভর্তুকি পেয়েছেন, বাকি টাকা শোধ করতে ছয় মাস সময় দিয়েছে মেটাল। আশরাফ মহাজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন মৌসুম থাকে, তখন ভালো আয় হয়। জীবনে পরিবর্তন এনেছে এ কম্বাইন্ড হারভেস্টর ।’

কৃষিযন্ত্রই ঋণের জামানত হতে পারে

সাদিদ জামিল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মেটাল

সাদিদ জামিল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মেটাল

কৃষির উন্নতি করতে যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। এতে এক ফসলে বছরে একাধিকবার উৎপাদন সম্ভব হয়। পাশাপাশি উৎপাদন খরচও কমে আসে। আর কৃষিযন্ত্রের মাধ্যমে দেশে গড়ে উঠছে উদ্যোক্তা শ্রেণি। যার মাধ্যমে অনেকের ভাগ্য বদলে যাচ্ছে। সরকার যন্ত্র কিনতে অর্ধেক টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এরপরও অনেক কৃষকের পক্ষে এত টাকা খরচ করে যন্ত্র কেনা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা কৃষকদের বাকিতে যন্ত্র দিচ্ছি। যদি ব্যাংকগুলো যন্ত্র কিনতে কৃষকদের ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দিত, তাহলে সহজেই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ হতো। ব্যাংক যদি গাড়ি কিনতে ঋণ দিতে পারে, কৃষিযন্ত্রে ঋণ দিতে সমস্যা কোথায়? এসব যন্ত্রই ঋণের জামানত হতে পারে। বিশ্বের যেসব দেশ কৃষিতে উন্নতি করছে, সেখানে যন্ত্রের ব্যবহার তত বেশি। কৃষি হলো অতীব জরুরি খাত। খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। তাই কৃষির উন্নতি করতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে।