সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের হিসাবের কাজটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞদের দিয়ে করানো হচ্ছে। সে জন্য নানা ধরনের জটিলতার পাশাপাশি ভালো ফল মিলছে না। সরকারি হিসাবে শৃঙ্খলা ফেরানোর সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হলে সনদধারী হিসাববিদসহ অভিজ্ঞ আর্থিক কর্মীদের নিয়োগের বিকল্প নেই।
রাজধানীর সোনারগাঁ হোটেলে গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত ‘সরকারি খাতে আর্থিক কর্মীদের আকৃষ্ট ও তাদের ধরে রাখা’ শীর্ষক গোলাটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও দ্য কনফেডারেশন অব এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক অ্যাকাউনট্যান্টস (কাপা) যৌথভাবে এটি আয়োজন করে।
গোলটেবিল আলোচনার প্রধান অতিথি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটি সত্য, সরকারি খাতের সংস্কারের জন্য অনেক দক্ষ ও মানসম্পন্ন আর্থিক কর্মী দরকার। অনেক দেশেই দক্ষ আর্থিক কর্মীদের সরকারি খাতে নিয়ে আসতে বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরাও ব্যতিক্রম নই। তবে আমার বিশ্বাস, এ বিষয়ে আইসিএবির সঙ্গে নীতিনির্ধারণী সংস্থাগুলো হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করবে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের দক্ষ আর্থিক কর্মী সরকারি খাতে নিয়ে আসতে ও তাঁদের ধরে রাখতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে তাঁরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করবেন, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।’ অর্থনৈতিকভাবে দেশ কতটা এগিয়েছে, সে বিষয়েও কথা বলেন তিনি।
আইসিএবির সভাপতি কামরুল আবেদিন বলেন, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) সরকারি ব্যয়ের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেয়ারবাজারের বড় অংশীদারও সরকার। তাই খাতটির নীতিনির্ধারণে শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং তা বাস্তবায়নে আর্থিক শৃঙ্খলা, সম্পদের সুষ্ঠু বরাদ্দ, দক্ষ জনবল ও জবাবদিহি দরকার। সনদধারী হিসাববিদদের সরকারি খাতে আসতে আকৃষ্ট ও ধরে রাখার মাধ্যমেই এ কাজগুলো ঠিকঠাকভাবে করা সম্ভব।
কামরুল আবেদিন বলেন, বিশ্বের সফল অর্থনীতির দেশগুলোতে সরকার ও হিসাববিদের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক থাকে। কারণ হিসাববিদেরা সরকারের হয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে সহায়তা করেন। অনেক দেশে হিসাববিদেরা সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার উপদেষ্টা হিসেবে পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, সংবাদদাতা ও সমালোচনার কাজ করছেন।
কাপার নির্বাহী পরিচালক ব্রায়ান ব্লাড বলেন, সরকারি খাতে উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন হিসাববিদ ও নিরীক্ষক খুবই দরকার।
এ সময় আরও বক্তব্য দেন কাপার পরিচালক আনোয়ারউদ্দিন চৌধুরী। পরে মূল আলোচনায় সরকারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা, ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও আইসিএবির নেতারা অংশ নেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, এমন না যে আমাদের পর্যাপ্ত হিসাববিদ নাই। আসলে সরকারকে একটি কাঠামো দাঁড় করাতে হবে, এই পদগুলো হিসাববিদদের জন্য। তবেই তো সনদধারী হিসাববিদ উৎসাহিত হবেন।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সব জায়গায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথা বলা হয়। তবে কাজের বেলায় কিছু হয় না। দক্ষ হিসাববিদ ছাড়াই সরকারের অধিকাংশ হিসাবকার্য চালানো হচ্ছে। এতে কখনোই ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে না।’ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ইনস্টিটিউটের ৯৮ শতাংশ পরিচালকই হিসাববিদ ও নিরীক্ষকের পার্থক্যই বোঝেন না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারি খাতে ব্যাপক হারে সনদধারী হিসাববিদ নিয়োগে রাজনীতিকদের সদিচ্ছা দরকার বলে মনে করেন আইসিএবির সাবেক সভাপতি আব্বাস উদ্দিন খান। তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একজন সনদধারী দক্ষ হিসাববিদ মাসে ৭ লাখ টাকা বেতন পান। সরকার দেয় মাত্র ৪০ হাজার। তাহলে কেন তিনি সরকারি চাকরি করতে আসবেন? তাই বেতনকাঠামো পরিবর্তন করা উচিত।’
অবশ্য এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন সাবেক অর্থসচিব মতিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি সনদধারী হিসাববিদ। মনে করি না বেতনটা খুব বড় বিষয়। আমি দেশের জন্য কিছু করতে চাই—এই দেশাত্মবোধ থাকতে হবে।’ সরকারি চাকরি অনেক সম্মানের ব্যাপার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।