দেশে ফ্রিজের বাজার বড় হচ্ছে
শহরে থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ–সংযোগ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে ফ্রিজ।
দেড় দশক আগে ওয়ালটন দেশে ফ্রিজের উৎপাদন শুরু করে। এর আগপর্যন্ত পণ্যটি আমদানিনির্ভর ছিল। ওয়ালটন আমদানি করা ফ্রিজের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে পণ্যটি সরবরাহ করায় সেটি অনেকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। এরপর ধীরে ধীরে দেশে ফ্রিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সরকারও নীতিসহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে। তখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিশ্বখ্যাত একাধিক ব্র্যান্ড দেশে ফ্রিজ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়। ফলে ধীরে ধীরে ফ্রিজে আমদানিনির্ভরতা কমছে। বর্তমানে পণ্যটির বাজারে দেশীয় কোম্পানিগুলোই দাপট দেখাচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করছে একাধিক প্রতিষ্ঠান।
দেশের ফ্রিজের বাজার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। গত বছরের মার্চে প্রকাশিত মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের (এমডব্লিউবি) এক গবেষণায় বলা হয়, ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের ফ্রিজের বাজার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে ফ্রিজের বাজারের আকার প্রায় ৬৮ কোটি মার্কিন ডলারের। ২০২২ সালে সেটি বেড়ে ৮৮ কোটি ডলার বা সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে পূর্বাভাস দেয়। ২০১৯ সালে দেশে প্রায় ৩২ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়।
ফ্রিজ উৎপাদন ও বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা জানান, করোনার কারণে বিক্রি কিছুটা কমেছে। এরপরও গত বছর কমবেশি ৩০ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে। বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির বাজার বড় হচ্ছে।
দেশীয় কোম্পানির দাপট
ক্রেতারা ফ্রিজ কেনার সময় দাম, স্থায়িত্ব, বিদ্যুৎ সাশ্রয়, নকশা, কম্প্রেসর, বিক্রয়োত্তর সেবা ও আধুনিক প্রযুক্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন। অন্যদিকে ফ্রিজ থেকে পানি বের হওয়া, কম্প্রেসরের উচ্চ শব্দ, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ, বেশি বরফ জমা, নির্দিষ্ট সময় পর পর কম্প্রেসরের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ রয়েছে। তবে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে মোটামুটি ভালো মানের ফ্রিজ তৈরিতে সক্ষম হওয়ায় দেশীয় ব্র্যান্ডের ফ্রিজ জনপ্রিয় হয়েছে বলে এমডব্লিউবির গবেষণায় উঠে এসেছে।
দেশীয় ব্র্যান্ডের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ওয়ালটন। ১৯৯৯ সালে চীন থেকে আমদানি করা টেলিভিশন বিক্রির মাধ্যমে ওয়ালটন ইলেকট্রনিকসের বাজারে যাত্রা শুরু করে। ২০০৫ সালের শেষ দিকে তারা গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিজস্ব জমিতে কারখানা গড়ে তোলে। সেই কারখানায় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ সালে, ফ্রিজ দিয়ে। ওয়ালটনের বার্ষিক উৎপাদনসক্ষমতা ৪২ লাখ ইউনিট ফ্রিজ। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি ফ্রিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কম্প্রেসর উৎপাদন শুরু করে।
ওয়ালটন কর্তৃপক্ষ জানায়, গত বছর তারা ২৩ লাখ ৮৫ হাজার ফ্রিজ বিক্রি করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওয়ালটনের কারখানায় তৈরি ফ্রিজ রপ্তানিও হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ফ্রিজ রপ্তানিতে ৬৫৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
জানতে চাইলে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্রিজের বাজারের ৭০ শতাংশ আমাদের দখলে। কাজটা একেবারে সহজ ছিল না। এর পেছনে অনেকগুলো সাপোর্ট ছিল। যেমন শতভাগ বিদ্যুতায়ন, দেশীয় ইলেকট্রনিকস শিল্পের জন্য সরকারের বিভিন্ন নীতিসহায়তা।’
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ২০১৪ সালে ফ্রিজের ব্যবসা শুরু করে। নরসিংদীতে তাদের কারখানায় দিনে দেড় হাজার ফ্রিজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ভিশন ও ভিগো ব্র্যান্ড নামে দেশে বাজারজাত করার পাশাপাশি গত বছর ভারত ও নেপালে ফ্রিজ রপ্তানি শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। তাতে ফ্রিজের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে।
ফ্রিজের বাজারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম যমুনা ইলেকট্রনিকস। ২০১৪ সাল থেকে যমুনা ব্র্যান্ড নামে ফ্রিজ বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। জানতে চাইলে যমুনা ইলেকট্রনিকসের পরিচালক (বিপণন) সেলিম উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর বেচাকানা বড় শহরকেন্দ্রিক। আর দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো শহরের পাশাপাশি গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে গেছে। ঈদ সামনে রেখে চলতি মাসে ৬০ হাজার ফ্রিজ বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বলে জানালেন তিনি।
ফ্রিজের বাজারে নবাগত দেশীয় ব্র্যান্ড ওরিয়ন। গত বছরের শুরুতে বাজারে পণ্য নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে তাদের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৩ লাখ ইউনিট ফ্রিজ।
ওরিয়ন হোম অ্যাপ্লায়েন্সের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. আবু তারিক জিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ফ্রিজ তৈরি করছি। এখন পর্যন্ত ৪০টি মডেলের ফ্রিজ বাজারে এনেছি। তার মধ্যে ২৮৫ থেকে ৩১৫ লিটারের ফ্রিজ রয়েছে। দাম ২২ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আগামী বছর আমরা ফ্রিজ রপ্তানি করার লক্ষ্যে এগোচ্ছি।’
দেশে উৎপাদনে বিদেশি ব্র্যান্ড
বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড স্যামসাং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে দেশে ফ্রিজ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস। বাজারজাতের সঙ্গে আরও যুক্ত আছে ট্রান্সকম, বাটারফ্লাই, র্যাংগ্স ও ইলেক্ট্রা ইন্টারন্যাশনাল। গত বছর স্যামসাং ৬৫ হাজার ফ্রিজ বিক্রি করেছে। তার আগের বছর তাদের বিক্রি ছিল ৩৫ হাজার।
জানতে চাইলে স্যামসাং বাংলাদেশের প্রোডাক্ট ম্যানেজার রেজাউল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বছরে যে পরিমাণ ফ্রিজ বিক্রি করি, তার ৯০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত। দেশে উৎপাদন করলেও স্যামসাংয়ের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়।’ তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ইলেকট্রনিকস পণ্যের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সেটিকে মাথায় রেখেই ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করছি। চলতি বছর ১ লাখ ২৫ হাজার ফ্রিজ বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আমাদের।’
চীনা ব্র্যান্ড কনকা দেশে উৎপাদন করছে ইলেক্ট্রো মার্ট। সোনারগাঁয়ে স্থাপিত কারখানায় কনকার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড হাইকোর ফ্রিজও উৎপাদন করছে। বর্তমানে তাদের উৎপাদনসক্ষমতা বার্ষিক ৩ লাখ ফ্রিজ।
জানতে চাইলে ইলেক্ট্রো মার্টের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল আফসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইলেকট্রনিকস পণ্যের জন্য বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময়। সেই হিসেবে আমাদের ধারণা, আগামী ১০ বছরের মধ্যে ফ্রিজের বাজার দ্বিগুণ বড় হবে।’ তিনি আরও বলেন, ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে সরকার যেসব নীতিসহায়তা দিচ্ছে, সেটি আরও বেশ কয়েক বছর অব্যাহত রাখলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হবে। অন্যদিকে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের বিনিয়োগ তুলতে সক্ষম হবে।
ফ্রিজের বাজার চাঙা
কয়েক বছর আগেও গ্রীষ্মকাল এলেই শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসির বিক্রি বাড়ত। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফ্রিজও। এবার বৈশাখ ও ঈদ কাছাকাছি হওয়ায় এবং এ সময়ে গরমের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ফ্রিজের বিক্রি অন্যান্য বছরের তুলনায় ভালো বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
ইলেক্ট্রা ও স্যামসাং ফ্রিজের বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত ইলেক্ট্রা ইন্টারন্যাশনালের মহাব্যবস্থাপক (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) মো. মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আমরা মুনাফা কমিয়ে দিয়েছি। তাতে আমরা ১৫ হাজার ৪০০ থেকে ৯৪ হাজার ৮০০ টাকায় ফ্রিজ বিক্রি করতে পারছি।’ তিনি জানান, গত দুই বছর তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ফ্রিজের বিক্রি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
এমডব্লিউবির গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে তিন ধরনের ফ্রিজ বিক্রি হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফ্রস্ট ফ্রিজের বাজার হিস্যা ৮৫ শতাংশের কাছাকাছি। নন ফ্রস্ট ৮ দশমিক ৩৩ এবং চেস্ট বা ডিপ ফ্রিজ ৬ দশমিক ৭ শতাংশের মতো বিক্রি হয়।
সাধারণ সময়ের তুলনায় চলতি মাসে ২০-৩০ শতাংশ বেশি ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন ট্রান্সকম ডিজিটালের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (বিপণন) মো. মাহবুব হাসান। তিনি বলেন, জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফ্রিজের চাহিদা বাড়ছে। অন্যদিকে রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের ক্রেতাদের মধ্যে সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রুচি ও চাহিদারও পরিবর্তন হয়। ফলে পুরোনো ফ্রিজ বদলে নতুন কেনার প্রবণতাও বেড়েছে। তিনি জানালেন, ট্রান্সকম ডিজিটাল বর্তমানে নিজেদের ব্র্যান্ড ট্রান্সটেক ছাড়া বৈশ্বিক ব্র্যান্ড স্যামসাং, ওয়ার্লপুল ও হিটাচির ফ্রিজ বিক্রি করে।