বিশ্বমন্দার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের কৌশলগত বিনিয়োগ থাকা উচিত। বর্তমান বাজার অর্থনীতিতে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে পরিস্থিতি খুব বেশি মোকাবিলা করা যায় না। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে সরকারের পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা উচিত। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মতো মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া প্রনয়ণের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় গতকাল বৃহষ্পতিবার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এসব কথা বলেন। তিনি মূলত বোঝাতে চেয়েছেন, অর্থনীতিতে সরকারের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। সবকিছু বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। এটি একধরনের কৌশল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো খাতে সরকারের বিনিয়োগ থাকলে জনগণ কিছুটা রাষ্ট্রীয় সুবিধা পায়। এতে দরিদ্র মানুষের পক্ষেও সুলভে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া সম্ভব হয়। এভাবে বাজার অর্থনীতির মধ্য থেকেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ সুবিধাগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে এ ধরনের সেবা খাত ছেড়ে দেওয়া হলে কোনো কারণে অর্থনীতি মন্দায় পড়লে জনগণের সেবা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।
ওয়াহিদউদ্দিন আরও বলেন, ৫০ ও ৬০-এর দশকে বিভিন্ন দেশের সরকারই সব খাতে বিনিয়োগ করত। বেসরকারি খাতের খুব বেশি অংশগ্রহণ ছিল না। এরপর বাজারমুখী অর্থনীতির যাত্রা শুরু হলো। সবকিছুই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে হতে লাগল। সরকার শুধু সুবিধা তৈরি করে দেয়। কিন্তু নতুন শতাব্দীতে এসে উপলব্ধি হলো— যতই বাজারমুখী অর্থনীতি হোক না কেন, সরকারের কিছু কৌশলগত বিনিয়োগ থাকা দরকার। এ জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে জনগণকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কিছুটা সুবিধা দেওয়া যায়। এর পাশাপাশি আর্থিক খাতে অস্থিরতা দূর করার দিকে মনোযোগী হতে হবে।
এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মনে করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ হতেই হবে। অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কৃষি খাতে উন্নয়নও অব্যাহত রাখতে হবে। এ দেশে নগরায়ণে মূল সমস্যা হলো, জমির স্বল্পতা। তিনি বলেন, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ভিত্তি হবে কোনো একটি অঞ্চলের অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। যে এলাকায় কৃষিই প্রধান সেখানে কৃষিভিত্তিক নগরায়ণ ও শিল্পায়ন গড়ে তুলতে হবে। আবার যেখানে শিল্পের কাঁচামাল জন্মায়, সেখানে শিল্পভিত্তিক নগরায়ণ গড়ে তুলতে হবে।
বিষয়টি এ রকম যে মুন্সিগঞ্জে আলুর উৎপাদন বেশি হয়। তাই সেখানে আলুর উৎপাদনকেন্দ্রিক নগরায়ণ করতে হবে। আলুচাষিরা যাতে উৎপাদনের সব উপকরণ পান, সেসব পণ্যের সহজলভ্যতা আনতে হবে সেখানে। আবার রাজশাহীতে রেশম উৎপাদন হয়। তাই রাজশাহী জেলাকে পুরোপুরি রেশম শিল্পনগর করতে হবে। শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে রেশম শাড়ি পর্যন্ত সবই তৈরি হয় রাজশাহীতে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার গ্রামপ্রধান এ দেশকে ধীরে ধীরে ছোট ছোট শহরভিত্তিক বাংলাদেশে পরিণত করতে যাচ্ছে। পল্লি জনপদ নামে একটি প্রকল্প পাস করা হয়েছে। মন্ত্রী আরও বলেন, সরকারের এ মেয়াদেই পদ্মার দুই পারকে ঘিরে হংকংয়ের মতো ‘টাউনশিপ’ গড়ে তোলা হবে। এতে করে কৃষি জমি বাঁচবে। এখন থেকে নগরায়ণ হবে উলম্ব কাঠামোতে। এর ফলে দেখা যাবে কিশোরগঞ্জের মতো এলাকাতেও ১৫ তলার একটি ভবন স্থাপিত হচ্ছে।
সভার শেষদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আইয়ুবুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, পরিকল্পনায় যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, তা কখনো অর্জিত হয় না। চলতি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শুধু প্রবাসী আয়ের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। অন্য কোনো খাতে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। আবার গণমাধ্যমে দেখি, অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীর মধ্যে একধরনের মতবিরোধ রয়েছে।
এ সময় অধ্যাপক ভুঁইয়াকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আপনি কি অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন? যেকোনো পরিকল্পনায় লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়। লক্ষ্য সব সময়ই বেশি দিতে হয়। তা না হলে কাজের অগ্রগতি হয় না, গতি আসে না।’
উল্লেখ্য, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। বাস্তবে অর্জিত হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। একই অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির গড় লক্ষ্য ছিল সাত শতাংশ। অর্জন করা সম্ভব হয়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রবাসী আয়ের লক্ষ্য ছিল ১ হাজার ৪২০ কোটি ডলার, আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার। এ ছাড়া রপ্তানি, রাজস্ব, বেসরকারি বিনিয়োগ—এসব লক্ষ্যের কোনোটিই অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
নারী সমাজকে উৎপাদনশীল কাজে সম্পৃক্ত করার তাগিদ দেন বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি হাসিনা নেওয়াজ। তাঁর মতে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এখন ৬ শতাংশে আটকে গেছে। এ শিকল থেকে বের হতে হলে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী সমাজকে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সরকারকে একই কাজে নারী-পুরুষভেদে বেতন বৈষম্য কমানোরও পরামর্শ দেন এই নারী উদ্যোক্তা।
উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি নাজ ফারাহ বলেন, দামি পাথর কেটে প্রক্রিয়াজাতকরণের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। নারীরা এ কাজে বেশি পারদর্শী। এ দেশে শ্রীলঙ্কার বিনিয়োগে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও এ খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন।
২০১৬-২০২০ মেয়াদে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রনয়ণের উদ্যোগ নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নেওয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে সভা করছে পরিকল্পনা কমিশন। এর অংশ হিসেবে গতকালের সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পরিকল্পনার খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে বলে জিইডি সূত্রে জানা গেছে। এতে মূলত মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে কী ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হবে—সেই পরিকল্পনা থাকবে।