অবস্থান পাল্টাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

তিন বছর আগে এক্সচেঞ্জ কোম্পানিটি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন আবার কোম্পানিটিকে ২৬ কোটি টাকা দিতে বলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক

অনবরত লোকসান ও অনিয়মের কারণে তিন বছর আগে জনতা ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি (জেইসি) এসআরএল ইতালি’র কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন জেইসি ইতালির লোকসানের পরিমাণ কম ছিল, যা বেড়ে এখন ২৬ কোটি টাকা হয়েছে।

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জেইসি এসআরএল ইতালিকে লোকসান বাবদ ২৫ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ ইউরো অর্থাৎ ২৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা দেওয়ার পক্ষে সায় দিয়েছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগে জেইসি ইতালিকে টাকা দেওয়ার পক্ষে সরকার সম্মত হয়েছে। এভাবে টাকা দেওয়াকে বলা হচ্ছে ‘পুনর্ভরণ’।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে বিদায়ী বছরের ৯ মে জুম প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জেইসি ইতালিকে পুনর্ভরণের নামে টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী জনতা ব্যাংক গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে একবার করে পাঁচ দফা বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। বিষয়টি সাত মাস ঝুলিয়ে রেখে অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংক অবস্থান পাল্টে কোম্পানিটিকে টাকা দেওয়ার পক্ষে মত দিল। জনতা ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

জেইসি এসআরএল ইতালিকে পুনর্ভরণের নামে টাকা দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি এখনো আমার কাছে আসেনি। এলে দেখব কী করা যায়।’

অনুমোদনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য জনতা ব্যাংককে শর্ত দিয়েছে। বলেছে, জেইসি ইতালিকে ২০২২ সালের মধ্যে লাভজনক করা না গেলে অবসায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।

জনতা ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, জেইসি ইতালি সম্প্রতি একটি সময়ভিত্তিক কৌশলগত ব্যবসায়িক পরিকল্পনার খসড়া পাঠিয়েছে। এরপর গত ১৪ ডিসেম্বর জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খসড়াটি অনুমোদনের জন্য ২৩ ডিসেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হয়।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুছ ছালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, পুনর্ভরণ বিষয়ে অনুমোদন পেতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে আবেদন করা হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক যে শর্ত দিয়েছে, সে অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যেই কোম্পানিটিকে লাভজনক করা হবে।

অথচ সুপারিশ ছিল বন্ধ করার

জনতা ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে ইতালির রোম ও মিলানে দুটি কোম্পানি খোলে জনতা ব্যাংক। ২০০৮ সাল পর্যন্ত দুটি কোম্পানি লাভজনক ছিল। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে লোকসান শুরু হয়। ২০১৮ সালে জেইসি ইতালির লোকসানের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ইউরো। ওই লোকসান পুনর্ভরণের অনুমতি পেতে জনতা ব্যাংক তখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ধরনা দিলেও কোনো লাভ হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকও সেই বছরের সেপ্টেম্বরে জনতা ব্যাংকের আবেদন নাকচ করে জেইসি ইতালির কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়।

কিন্তু বন্ধ করার নির্দেশনাটি আবার একসময় আটকে যায়। তখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পরামর্শে লাভজনক করতে কোম্পানিটিকে দুই বছরের একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে বলা হয়। কোম্পানিটি তা করেও।

সূত্র জানায়, মূলধন ঘাটতি থাকায় জেইসি ইতালি এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে।

আগে বন্ধ করার সুপারিশ করে এখন আবার টাকা দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিল কেন, এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে রাজি হননি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম।

বিদেশে অবস্থিত এক্সচেঞ্জ হাউস ও শাখাগুলোর ওপর ২০১৭ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগ। বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস ও শাখাগুলো পরিদর্শন হওয়ার কথা থাকলেও এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

জনতা ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি আইএনসিও (জেইসিআই) বন্ধ হয়ে গেছে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে এক্সচেঞ্জ কোম্পানিটিতে ৬ লাখ ৪ হাজার ডলার চুরি হয়, যা উদ্ধার হয়নি।

আরও যেগুলো বন্ধ হয়েছে

জনতা ব্যাংক যুক্তরাজ্যেও ছয়টি শাখা খুলেছিল। এর মধ্যে চারটি শাখা লোকসানের কারণে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ওল্ডহ্যাম শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে শাখাটির তৎকালীন ব্যবস্থাপক ইকবাল আহমেদের বিরুদ্ধে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে।

লোকসানে থাকায় ২০২০ সালে বন্ধ করা হয় লুটন, কেমডেন ও ব্র্যাডফোর্ড শাখা। বর্তমানে চালু আছে বার্মিংহাম ও লন্ডনের প্রধান শাখা। এ দুটো শাখার অবস্থাও কিন্তু খারাপ। তাই শাখা দুটি টিকিয়ে রাখতে সরকার ও সোনালী ব্যাংক মিলে ৩০০ কোটি টাকার বেশি দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে অনিয়ম যেমন আছে, তেমনি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাও আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিরও অভাব রয়েছে। ফলে সবার আগে লোকসানের কারণ খুঁজে বের করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ আর লোকসান হলে এটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।