পারিবারিক আয় বাড়াচ্ছে বিকাশ

আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়েছে। নারী-পুরুষের ব্যবধান কমেছে। এমএফএস সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের নাজমুন নাহার জানেন না তাঁর স্বামী কোথায়। বিয়ের কিছুদিন পর তাঁর স্বামী বিদেশে চলে যান। এরপর কিছুদিন নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, টাকাও পাঠান। কিন্তু একপর্যায়ে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তিনি। নিরুপায় হয়ে নাজমুন নাহার জীবিকা নির্বাহের জন্য টঙ্গীর একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। কিন্তু সন্তানের দেখাশোনা নিয়ে সমস্যা হওয়ায় বেশি দিন কাজ করতে পারেননি। দুই বছর পর তিনি বাবার বাড়িতে ফিরতে বাধ্য হন।

এরপর শুরু হয় নাজমুন নাহারের নতুন সংগ্রাম। সেলাই মেশিন কিনে ঘরে বসে কাজ শুরু করেন। দুটি দরজির দোকান থেকে কাজের ফরমাশও নেন। প্রথম দিকে কাজের টাকা আনতে তাঁকে মাসে কয়েকবার উপজেলা সদরে যেতে হতো। তবে এখন বিকাশের কল্যাণে সহজেই ঘরে বসে লেনদেন করতে পারেন তিনি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক সমীক্ষায় নারীর অগ্রগতির এমন চিত্র উঠে এসেছে। মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশের প্রভাব নিয়ে সমীক্ষাটি করা হয়।

গত ১০ বছরে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়েছে। ফলে নারী-পুরুষের ব্যবধান কমেছে। এ ক্ষেত্রে এমএফএস বা মোবাইল ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। পিআই স্ট্র্যাটেজি ডট ওআরজির হিসাবমতে, দেশে বর্তমানে (জানুয়ারি-২০২১) ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষের ব্যাংক হিসাব আছে। আর মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব আছে ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের, যাঁদের অনেকের ব্যাংক হিসাবও আছে।

পারিবারিক আয় বৃদ্ধি

গবেষণার ফলাফল বলছে, বিকাশ ব্যবহারের ফলে পারিবারিক পর্যায়ে অকৃষি (নন-ফার্ম) আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বেড়েছে৫ দশমিক ৮ শতাংশ। বিকাশ ব্যবহারের সুবাদে মৎস্য চাষ থেকেও পারিবারিক আয় বেড়েছে। আয়ের পাশাপাশি ভোগের ক্ষেত্রেও বিকাশ ব্যবহারের প্রভাব রয়েছে।

যেসব খানা বা পরিবার বিকাশ ব্যবহার করে এবং যারা ব্যবহার করে না, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন অভিঘাতের সময় তাদের আয়, ব্যয় ও ভোগের ওপর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে গবেষণায়। দেখা গেছে, যেসব পরিবার অভিঘাতের সময় বিকাশ ব্যবহার করেনি, তাদের অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স কমেছে ৬১ শতাংশের বেশি। মাথাপিছু আয় কমেছে ১৭ শতাংশ। তবে মাথাপিছু ভোগে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। অন্যদিকে যেসব পরিবার অভিঘাতের সময় বিকাশ ব্যবহার করেছে, তাদের অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স ৬০ শতাংশ বেড়েছে। পরিণতিতে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২৮ শতাংশ। একই সঙ্গে মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ।

বলা হয়েছে, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিকাশের ব্যবহার বেড়ে যায়। বন্যার সময়ে ক্যাশ ইন ৩৩ শতাংশ এবং ক্যাশ আউট ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদারে নগদ টাকা হস্তান্তর কার্যক্রমে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

সামাজিক প্রভাব

এমএফএসের সামাজিক প্রভাবও লক্ষণীয়। গবেষণার ফল বলছে, এমএফএস ব্যবহারকারী পরিবারগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এমএফএসহীন পরিবারগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় করে থাকে। সাধারণ তুলনায় দেখা গেছে, যাদের এমএফএস আছে, তারা শিক্ষা বাবদ এমএফএসহীন পরিবারগুলোর তুলনায় বছরে তিন হাজার টাকা বেশি ব্যয় করে। বিকাশের ক্ষেত্রে পার্থক্য আরও বড়—৪ হাজার ৩০০ টাকা। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতেও বিকাশ ব্যবহারকারীরা বেশি ব্যয় করেন—পার্থক্য বছরে ৫২০ টাকা। পাশাপাশি বিকাশ বা এমএফএস ব্যবহারকারীরা বেশি সচেতন। বিকাশ ব্যবহারকারীরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন বেশি।

নারীর ক্ষমতায়ন

এই সমীক্ষায় এমএফএস, অর্থাৎ বিকাশ ব্যবহারে নারীদের জীবনে কী প্রভাব পড়েছে, তা নিরূপণে বিভিন্ন মডেল ব্যবহার করা হয়েছে। দেখা গেছে, যে নারীরা বিকাশ ব্যবহার করেন, চলাচলের স্বাধীনতা সূচকে তাঁরা বিকাশ হিসাবহীন নারীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এই পার্থক্যের সঙ্গে বিকাশ ব্যবহারের সম্পর্ক আছে বলে মত দেন গবেষকেরা। অর্থাৎ, যে নারীরা বিকাশ ব্যবহার করেন, তাঁদের চলাচলের স্বাধীনতা বেশি। নারীর ক্ষমতায়নে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূচক বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সূচকেও বিকাশ ব্যবহারকারী নারীরা এগিয়ে আছেন। চলাচলের স্বাধীনতা বৃদ্ধির যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভূমিকা বেড়েছে। বিকাশ সে ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

পাশাপাশি সম্পদ ধারণ ও শ্রম থেকে আয়ের ক্ষেত্রেও বিকাশ ব্যবহারকারী নারীরা অনেক এগিয়ে। আর্থিক সম্পদের ক্ষেত্রে বিকাশ ব্যবহারকারীরা অন্য নারীদের চেয়ে ২০ শতাংশ এগিয়ে আছেন। শ্রম আয়ের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য আরও বেশি। বিকাশ ব্যবহারকারী নারীরা অন্যদের চেয়ে ৮৬ শতাংশ বেশি আয় করে থাকেন। ব্যাপারটা শুরুতে বলা নাজমুন নাহারের ঘটনা থেকে পরিষ্কার হয়। বিকাশ বা এমএফএস থাকার কারণে তিনি এখন ঘরে বসেই কাজের মজুরি গ্রহণ করতে পারছেন, কিন্তু যাঁদের এমএফএস নেই, তাঁদের পক্ষে এটি সম্ভব নয়। এতে সন্তানের পড়াশোনা ও পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভূমিকা বেড়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলেন, খানা বা পরিবারের খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থায়নের মূল উৎস অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স। এমএফএস সেই লেনদেন সহজ করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে এর বড় ভূমিকা আছে। শহরে পড়াশোনারত শিক্ষার্থীরা এমএফএসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ পাচ্ছে। এতে তাদের শিক্ষাকার্যক্রম সহজ হয়েছে। সামগ্রিকভাবে খানার সদস্যদের স্বাস্থ্যসুরক্ষায় ব্যয় বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক বলেন, এই জরিপে নারীর ক্ষমতায়নের বিভিন্ন সূচক, যেমন সহজে চলাচল, পরিবারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা পালন, নিজস্ব প্রয়োজনে অর্থায়ন, সামাজিক সচেতনতা, ক্ষমতায়ন প্রভৃতিতে এমএফএস গ্রাহকদের ভালো অবস্থানে দেখা গেছে। তাঁর মত, এমএফএসের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে, জেন্ডারভিত্তিক ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস ও ডিজিটাল শিক্ষণ নিশ্চিত করা। এতে নারীরা স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত হয়ে আর্থিক লেনদেন করতে পারবেন।

বিআইডিএসের গবেষণায় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার বিকাশ গ্রাহকদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। গ্রাহকেরা জানান, তাঁরা মূলত ব্যাংকে যাওয়ার ঝামেলা এড়াতে বিকাশ ব্যবহার করেন।