হুন্ডিমুখী নয়, ব্যাংকমুখী করতে হবে প্রবাসীদের

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়ে প্রবাসী আয় বাড়ানোটাই বাজেটের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

আসছে বাজেট ২০২২–২৩

কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি ডলারের নতুন দাম বেঁধে দিয়েছে ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা। ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের থেকে ডলার কিনেছে ৯৩ থেকে ৯৪ টাকায়। আর খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ৯৬ টাকায়। ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের বিনিময় হারের এই পার্থক্য বৈধভাবে প্রবাসী আয় দেশে ফেরানোর বড় বাধা।

ব্যাংকে টাকা কম পেলে প্রবাসীরা হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এতে তাঁরা ডলারপ্রতি দুই-তিন টাকা বেশি পান। এখন হুন্ডি থেকে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় ফেরানোটাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এ ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলে চলমান অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত দেশের বাইরে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯৭৯ জনের। যেখানে গত বছরের এই একই সময়ে বিদেশে কাজের জন্য পাড়ি দিয়েছিল ১ লাখ ৯৫ হাজার ২৪০ জন। সেই হিসাবে এই বছরের প্রথম পাঁচ মাসে জনশক্তি রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫৮ শতাংশ। কিন্তু পাঁচ মাসে গত বছরের তুলনায় প্রবাসী আয় কম এসেছে ৯৪ কোটি ডলার। ২০২১ সালের প্রথম পাঁচ মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ৯৮৯ কোটি ডলার। ২০২২ সালে একই সময়ে সেটা কমে হয়েছে ৮৯৫ কোটি ডলার।

‘প্রবাসীদের হয়রানি কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তাঁরা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হন, এর প্রতিকারে চলতি উদ্যোগগুলো আরও শক্ত করতে হবে। এ ছাড়া প্রবাসীদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা বিধানে সরকারের আলাদা ভাবনা দরকার। তাঁদের দক্ষতা বাড়লে, জীবনমান উন্নত হলে, আয়ও বাড়বে।
তাসনিম সিদ্দিকী, মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি

সরকার অবশ্য বসে নেই। নানাভাবে চেষ্টা করছে কীভাবে প্রবাসী আয় বৈধ চ্যানেলে ফেরানো যায়। ইতিমধ্যে প্রবাস থেকে ৫ হাজার ডলার বা ৫ লাখের বেশি টাকা পাঠাতে আয়ের নথিপত্র জমা দেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, সেটা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকা পাঠালে তার বিপরীতে আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনাও পান।

তবে সরকারের এসব পদক্ষেপ হুন্ডির কাছে টিকছে না উল্লেখ করে মালেশিয়ান প্রবাসী মনসুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতে হলে ব্যাংক কর্মকর্তারা যেসব প্রশ্ন করেন, তার উত্তর দেওয়ার ভয়ে অনেকে ব্যাংকে যেতে চান না। তার কাছে তখন সহজ সমাধান হয়ে ওঠে হুন্ডি। এখন এটা আরও সহজ। দেশে হুন্ডির স্থানীয় এজেন্টরা টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে পাঠিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়া এতটাই সহজ যে তাতে করে সরকারি প্রণোদনাও অনেকে প্রয়োজন মনে করেন না। কারণ, হুন্ডিতে ওই বাড়তি টাকা তার পরিবার পেয়েই যায়।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের সমস্যা সমাধানে সরকারকে শুধু সাময়িকভাবে ভাবলে হবে না, নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। অবকাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে বৈধ পথে প্রবাসী আয় ফেরানোর সংস্কৃতি। আড়াই শতাংশ প্রণোদনার মতো বিষয়, সাময়িক সময়ের জন্য কাজে এলেও, এটা দীর্ঘ মেয়াদে চলমান রাখা সরকারের জন্য সম্ভব না–ও হতে পারে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা যেটা বলে ব্যাংক ও খোলাবাজারে বিনিময় হারে বড় ধরনের পার্থক্য হলে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা কমে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী আয়ে যে মন্থর গতি, সেটার জন্য এটা একটা কারণ হতে পারে। তবে বিষয়টিকে এত হালকাভাবে দেখা যাবে না। কোনোরকমের গভীর অনুসন্ধান ছাড়া ঢালাওভাবে বলা ঠিক হবে না যে এই একটিমাত্র কারণেই প্রবাসী আয় কমছে। সরকারের উচিত কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হলো, তা এখনই খুঁজে দেখা। এবং প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করা। তাহলে বৈধ পথে প্রবাসী আয় ফেরানো খুব বেশি কঠিন হবে না।’

আরও পড়ুন

তবে এর বাইরেও আসন্ন বাজেটে প্রবাসীদের জন্য আলাদাভাবে ভাবনা থাকা প্রয়োজন, যাতে তারা দেশে অর্থ পাঠাতে উৎসাহ পাবেন। প্রবাসী হিসেবে তাদের যথেষ্ট সম্মান বা সমাধানের সঙ্গে দেশের নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া পাসপোর্ট নবায়ন ও বিমানবন্দরের মতো জায়গায় পদে পদে যেসব ভোগান্তিতে পড়তে হয়, তা যেন লাঘব করতে সরকারকে আরও আন্তরিক হওয়া দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রবাসী প্রতিটি পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসীদের হয়রানি কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তাঁরা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হন, এর প্রতিকারে চলতি উদ্যোগগুলো আরও শক্ত করতে হবে। এ ছাড়া প্রবাসীদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা বিধানে সরকারের আলাদা ভাবনা দরকার। তাঁদের দক্ষতা বাড়লে, জীবনমান উন্নত হলে, আয়ও বাড়বে। এ জন্য শুধু প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় নয়, আন্তমন্ত্রণালয় উদ্যোগের মাধ্যমে প্রবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে এই বাজেটে আলাদা উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।’